আমি একবার বাংলাদেশে গিয়ে গুলিস্তানে এই ছেলেটির সাথে দেখা

 

আমি একবার বাংলাদেশে গিয়ে গুলিস্তানে এই ছেলেটির সাথে দেখা। রিক্সাটা সদরঘাটের দিকে মুখ করে রেখে যাত্রীর জন্যে রিক্সার উপরে বসে আছে। আমি ওর রিক্সার সামনে পড়াতে জিজ্ঞেস করছিলো, স্যার যাবেন? মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বললাম, যাবো।
ছেলেটি ঐ ভর দুপুরে সদরঘাট ছাড়া কোথাও যাবেনা । আমার গন্তব্য বাসাবো, মানে একেবারেই উলটা পথ । কিন্তু ছেলেটার চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর যাত্রী হবার লোভ সামলাতে পারলাম না । রিক্সায় চড়ে বললাম চলো সদরঘাঁট । মনে মনে ভাবলাম সদরঘাঁটও ১০ বছর হয় দেখিনা ।
রিক্সায় চড়ে ওর সাথে নানা রকমের কথা হল, ঢাকার বাহীরে কোন এক জেলাতে তার বাড়ী । এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকাতে এসেছে রিক্সা চালাতে, রিক্সা চালিয়ে কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে এইচএসসিতে ভর্তি হবে বলে আমাকে জানালো । ওর বাবা নেই, মা বিভিন্ন ছোটা কাজ করে সংসার চালায়, সংসারে ও ছাড়া আছে ছোট এক বোন ।
কথায় কথায় সদরঘাট পৌঁছে গেলাম । ঐ সময়ে ভাড়া ৬০/৭০ টাকা হবে হয়তো । আমি ওকে ৫'শ টাকা দিয়ে বললাম, রেখে দাও । কিছুতেই সে রাখবেনা। অতিরিক্ত টাকা যেহেতু সে নিবেনা, তাই মিথ্যা করেই বললাম তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করো, টার্মিনালে একটা কাজে এসেছি, কাজ করে তোমাকে নিয়েই গুলিস্তান যাবো।
আমি টার্মিনালে গিয়ে কিছু লঞ্চ আর মানুষের যাতায়াত দেখে ফিরে এসে ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে কিছু খেয়ে ফের গুলিস্তানের দিকে রওয়ানা দিলাম, ততোক্ষনে ওর সাথে আমার বেশ খানিকটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে উঠেছে। যদিও সে রেস্টুরেন্টে খেতে চাইছিল না।
কথার এক ফাঁকে ও আমাকে বলল, স্যার জানেন ! -আমি ভালো ছাত্র নই বলে অনেকেই আমাকে তাচ্ছিল্য করে বলে -লেখাপড়া করে কি করবি!!!
আমিও জিজ্ঞেস করলাম লেখাপড়া করে আসলেই তুমি কি করতে চাও? উত্তরে বলল -আমি বড় চাকুরীর আশায় লেখাপড়া করছিনা, লেখাপড়া শেখা আমার শখ, লেখাপড়া করে প্রয়োজনে সারাজীবন রিক্সা চালাবো; মাঠে কাজ করবো, তবুও আমি এমএ পাঁশ করবো।
আমি মনে মনে বললাম 'তুমি তো এখনই এমএ পাঁশের চাইতে অনেক বড় কিছু , দেশের অনেক এমএ পাঁশ‘ওয়ালা যেন তোমার পা ধোঁয়া পানি খেয়ে কিছু শিখে ।
গুলিস্তান এসে ফুঁসলিয়ে টিএসসিতে নিয়ে এলাম, টিএসসিতে কিছুক্ষণ থেকে এলিফেন্ট রোড হয়ে বাসাবো ফিরে এসে ওকে এক হাজার টাকার দুইটা নোট এগিয়ে দিয়ে বললাম এটা রেখে দাও। ছেলেটি টাকাটা হাতে না নিয়ে আমাকে বলছে স্যার, আপনি মনে হয় বিদেশে থেকে থেকে দেশের দর দাম ভুলে গেছেন, আমার ভাড়া একহাজার টাকাও হবেনা। আমি বললাম, তোমাকে আমি ছোট ভাই হিসেবে দিলাম, রেখে দাও। না, সে নিবেনা।
আমি একটু জোড় করাতে আমাকে বলল স্যার, আমি সুস্থ্য মানুষ, কাজ করে টাকা কামাইতে পারি । প্রতিদিন আমি রিক্সা চালিয়ে ভালো টাকাই রোজগার করি, এবং এতে আমি খুশী । এর চাইতে বেশী টাকা আমার দরকার নেই । তাছাড়া আমি কারো সাহায্য নিয়ে বড় হতে চাইনা। সে সমস্ত হিসেব করে তার ভাড়ার টাকা নিয়ে বাকী টাকাটা আমাকে ফিরিয়ে দিলো ।
টাকাটা ফিরিয়ে দেয়াতে আমার ইগোতেই বোধ হয় একটু লাগছিল । টাকাটা নিতে আমি আরও একবার অনুরুধ করাতে ছেলেটি বললো, -আগে জানলে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত ব্যপারগুলো জানাতাম না, বাবা বলেছে -সিম্পেথি দেখিয়ে মানুষের থেকে যেন অতিরিক্ত সুবিধা না নেই ।
-সত্যিই,মানুষের সততার চাইতে বড় শক্তি আর সম্পদ অন্য কিছুতেই হয়না ।
আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম ১৭/১৮ বছর বয়সেই যদি একটি ছেলে এমন শক্তিশালী নার্ভ আর সত্ত্বা নিয়ে জীবনযাপন করে, তাহলে একে দাবীয়ে রাখার ক্ষমতা পৃথিবীর কেউ রাখেনা ।
-বাংলাদেশে এই ছেলেটির চাইতে বড় হিরো আর সম্পদশালী মানুষ অন্য কাউকে মনে হয়নি।
পুনশ্চঃ- ছবিটি অনুমতি ক্রমেই পোস্ট করেছিলাম ।
08 June 2020

Post a Comment

0 Comments