মুন্নীর কথা মনে আছে তো?




পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পতনের পেছনে বারবার আমরা মীর জাফরের দিকে আঙ্গুল তুলি কিন্তু ইংরেজ নবাবদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণ প্রিয় পত্র ছিলো 'মুন্নি বাই'


গত ৯ জানুয়ারি ২০২৪ মুন্নীকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম ৷ বিভিন্ন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামে-বেনামে লেখাটা এত বেশি কপি হয়েছে যে, প্রতিদিনই কারো না কারো মাধ্যমে পোস্টটা সামনে আসছে ৷ অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে মুন্নীকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ৷ অন্যরা যেহেতু লেখাটা কপি করেছে, সেহেতু তারা পাঠকের প্রশ্নের যথাযথ জবাব প্রদানে ব্যর্থ ৷ ফলে লেখার সত্যতা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছে ৷ ইতিহাসের নামে আমাদেরকে যা পড়ানো হয় তার অধিকাংশই কাল্পনিক গল্প ৷ তাই সত্য ইতিহাসও আমাদের কাছে গল্প মনে হয় ৷ ঊদাহরণ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথাই বলি -

আমাদের পড়ানো হয় বিদ্যাসাগর ল্যম্পপোস্টের আলোয় পড়ালেখা করতেন ৷ কিন্তু আপনি যদি অনুসন্ধান করেন, তাঁর জন্ম ১৮২০ সালে মৃত্যু ১৮৯১ সালে ৷ বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয় ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালে ৷ কলকাতায় প্রথম বিদ্যুৎ জ্বালানো হয় ১৮৮৯ সালে অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর মাত্র দুই বৎসর পূর্বে ৷ মায়ের ডাকে বিদ্যাসাগরের নদী পাড়ি দেওয়ার কথা কে না জানে! আনন্দ বাজার পত্রিকার এক সাক্ষাতকারে ঈশ্বরচন্দ্রের ভাই শম্ভুচরণ বলেছিলেন, তার ভাই সাঁতারই জানতেন না ৷ আর দমোদর নদী তখন এত উত্তাল নদী ছিলো যে তুখোড় সাঁতারুর পক্ষেও তা সাঁতার কেটে পার হওয়া সম্ভব ছিলো না ৷

ঈশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে যদি কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষার খাতায় এসব লিখে পরীক্ষক তাকে কখনোই নাম্বার প্রদান করবেন না ৷ কারণ, বছরের পর বছর ইতিহাসের ছাত্ররা এসবই পড়ে আসছে ৷ পরীক্ষক নিজেই মিথ্যা ইতিহাস পড়ে পাশ করেছেন ৷ শিক্ষার্থীরা কোন ইতিহাস পড়বে, পাঠ্যপুস্তকে কোন ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হবে, ক্ষমতায় যারা থাকে তারা নির্ধারণ করে দেয় ৷ সুতরাং ইতিহাসবিদ বা ইতিহাসের ছাত্র হয়ে যারা মুন্নী বাঈয়ের ইতিহাস জানেনেনি তাদের উত্তেজিত বা আফসোস করার কিছু নেই ৷

এখনকার দিনে নটী বা নর্তকী পাওয়া যতটা সহজলভ্য, তখনকার দিনে একেবারে অনন্যোপায় না হলে কেউ নটীর খাতায় নাম লেখাতো না ৷ উত্তর প্রদেশের সিকান্দ্রারার নিকটবর্তী বালুকুন্ডা গ্রামের এক গরীব বিধবা মায়ের সন্তান মুন্নী ৷ ভরণপোষণ করার সামর্থ্য না থাকায় তার মা তাকে বিশু বাঈ নামে এক নটীর কাছে বিক্রি করে দেয় ৷ মীরজাফরের সাথে মুন্নীর বিবাহ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে ৷ কারো মতে মীরজাফর নবাব হওয়ার পরে মুন্নীকে বিয়ে করেছে, কারো মতে নবাব হওয়ার পূর্বে বিবাহ করেছে ৷ মুন্নীর জলসাঘরেই মীরজাফর ও লর্ড ক্লাইভের সুসম্পর্ক তৈরি হয় ৷

সেই সময়ের প্রায় ইতিহাস নিয়ে পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায় ৷ যেমন- মোহনলালের বোন নবাব সিরাজে প্রেমিকার নাম কারো মতে মাধবী, কারো মতে হীরা, কারো মতে ফৈজী, কারো মতে আলেয়া, কারো মতে এটি একটি কাল্পনিক চরিত্র ৷ মুন্নীর চরিত্রটাও কাল্পনিক হতে পারতো কিন্তু মর্শিদাবাদের চক মসজিদ সাক্ষি দিচ্ছে তার বাস্তবতা ৷ মসজিদটি মীরজাফরের বেগম মুন্নী বাঈয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে বলে এটি "বেগম মসজিদ" হিসেবে পরিচিত ৷ কোন কোন ঐতিহাসিক মুন্নীর নাম মনি বেগম উল্লেখ করেছেন ৷

"জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভাল" এই নীতিতে মুন্নী হয়তো মহীয়সী নারী হিসেবে সমাজে পরিচিত হতে পারতো কিন্তু তেমনটা হয়নি ৷ লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়ারেন হেন্টংসের সাথে মুন্নীর বিশেষ সখ্যতা ছিলো ৷ ১৭৬৫ সালে মীরজাফর মারা গেলে মুন্নী তার ১৫ বছর বয়সী পুত্র নাজম-উদ-দৌলাকে নবাবের মসনদে বসানোর জন্য ক্লাইভকে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ প্রদান করে ৷ এর মাত্র পাঁচ বছর পর ১৭৭০ সালে দূর্ভিক্ষে বাংলা ও বিহারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো । ১৯৪৫ সালেও চার সদস্যের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারেরে মাসিক সর্বোচ্চ খরচ হতো মাত্র ১৫ টাকা ৷ তারও দুইশ বছর পূর্বে ৫ লক্ষ টাকার পরিমাণ কত হতে পারে সম্মানিত পাঠকগণ অনুমান করে নিবেন ৷

সিংহাসনে বসার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৭৬৬ সালে নাজম-উদ-দৌলা ম়ত্যুবরণ করলে এরপর সিংহাসনে বসে তার ছোট ভাই সাইফ উদ-দৌলা ৷ চার বছরের মাথায় তারও মৃত্যু হয় ৷ তারপর সিংহাসনে বসানো হয় মীরজাফরের তৃতীয় স্ত্রী আরেক নটী বব্বু বাঈয়ের ১২ বছর বয়সি পুত্র মোবারক-উদ-দৌলাকে । বব্বু বাঈ ছিলো মুন্নী বাঈয়ের মনিব বিশু বাঈয়ের গর্ভজাত কন্যা ৷ ঐতিহাসিকরা কেউ তাকে রব্বু বাঈ, কেউ বাবু বেগম হিসেবে সম্বোধন করেছেন ৷ দুই ছেলের শাসনকালে সত্যিকার অর্থে প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ ছিলো মুন্নীর হাতে ৷ সে সময় বব্বু ছিলো একেবারেই অন্তরালে ।

নটী থাকাবস্থাতেই দু'জনের মাঝে মনোমালিন্য চলে আসছিলো ৷ মীরজাফরের বেগম হওয়ার পরে সেটি আরো বাড়তে থাকে ৷ সৎ ছেলে মোবারক-উদ-দৌলা মসনদে বসতেই প্রাসাদের খবরদারি নিয়ে দুই সতীনের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে ৷ ১৭৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার ওয়ারেন হেন্টিংসকে গভর্ণর করে বাংলায় পাঠায় ৷ হেন্টিংসকেও ক্লাইভের মতো দেড় লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে মুন্নী প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয় ৷ হেন্টিংসের সুপারিশে বাৎসরিক ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা ভাতার বিনিময়ে নবাবের মহলের তত্ত্বাবধান ও তার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুন্নীকে ৷

বব্বু বাঈয়ের বাৎসরিক ভাতা নির্ধারণ করা হয় ৯৬ হাজার টাকা ৷ অন্যদিকে সেই সময় নবাব সিরাজ উদ দৌলার স্ত্রী লৎুফুন্নিসা বেগমকে মাসিক একশত টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হতো ৷ যদিও কেউ কেউ দাবি করেন যে, মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করা হতো ৷ যদি এক হাজার করেও ধরি, মীর জাফরের দুই নটীর তুলনায় তা ছিলো একেবারেই সামান্য ৷ ১৭৮৩ সালে মোবারক-উদ-দৌলা মারা যায় । এরপর মসনদে বসে তার ছেলে বাবর আলি খান ওরফে দ্বিতীয় মোবারক-উদ-দৌলা । এভাবেই পরবর্তী নবাবীর সিলসিলা চলে আসছিলো ৷ নবাবের আসনে শত বছর বসে থাকলেও নটীর পোলা নটীর পোলাই থাকে ৷ তাই সেদিকে যাচ্ছি না ৷

আমরা তাই দেখি যা আমাদের দেখানো হয় ৷ ভারত ভাগে আমরা কখনো জওহরলালকে দেখি, কখনো জিন্নাহকে, কিন্তু এর পেছনের লেডি মাউন্টব্যাটেনকে আমরা দেখি না ৷ পলাশীর প্রান্তরে আমরা মীর জাফর, জগৎশেঠ, ঘষেটিকে দেখি মুন্নীকে দেখি না ৷ ঘষেটিকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে অথচ মুন্নীর মৃত্যুর পর তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে নব্বইবার তোপধ্বনি করা হয়—অর্ধনমিত রাখা হয় বৃটিশ পতাকা । ইংরেজরা তার উপাধি দিয়েছিলো "মাদার অব কোম্পানী" ৷ মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডে অনেক গডফাদার এসেছে গেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত গডমাদার একজনই "দ্য কুইন অব মুম্বাই : হাসিনা পার্কার ৷" পলাশীর প্রান্তরেও অনেক গড ফাদার ছিলো কিন্তু গডমাদার একজনই, "মাদার অব কোম্পানী‌: মুন্নী বাঈ ৷"

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে একটা কথা আছে, যুগে যুগে মীরজাফররা যেমন ফিরে আসে তেমন মুন্নী বাঈয়েরাও ফিরে আসে, ফিরে আসে তাদের সন্তানেরা, ফিরে আসে আমাদের মতো নীরব জনতা ৷ আমাদের টাকা দিয়ে তারা ভীনদেশী নাগরকে সন্তুষ্ট করে ৷ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরেও আমরা নীরব দর্শক ছিলাম, এখনো নীরবই আছি ৷

© সাইদুর রহমান সৈয়দ

Post a Comment

0 Comments