"জাহান্নামী"



নেছারত দাদা যে জাহান্নামে যাবে, আমরা সবাই সেটা জানতাম। 

জুমার খুতবায় জান্নাতের সার্টিফিকেট পাওয়া দশ সাহাবীর নাম শুনেছিলাম। আর শুনেছিলাম আবু লাহাব, আবু তালিবদের নাম। আবু তালিবের কথা বলতে গিয়ে নজরুল নানা কান্না করে দিতেন। নবিজীরে এতো আদর করলো, এতো ভালোবাসলো, অথচ সেই আবু তালিবকে দেওয়া হবে জাহান্নামে!!

আহারে!আহারে!!

তবে নেছারত দাদার জন্য কেউ চোখের পানি ফেলে নাই। বরং উনি জাহান্নামে যাবে, কথাটা বলার সময় সবাইকে বেশ খুশি খুশিই দেখাতো। যেন কারো জাহান্নামে যাওয়াটা বিরাট আনন্দের ব্যাপার!!

নেছারত দাদাকে আমরা ছোটরা দূর থেকে দেখতাম। জাহান্নামি মানুষ কেমন হয়, দেখার খুব শখ ছিলো কি না!!

সেই নেছারত দাদাই একদিন আমারে হুট করে ডাকলেন, এই সাদিক, এদিক আয়। 

ভয়ে আতঙ্কে আমার প্রাণ উড়ে গেল। পা জমে গেল। আমি বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরসি পড়ার চেষ্টা করি। পারি না। কেন জানি আয়াতুল কুরসি আমার মনে থাকে না কখনোই। 

আমাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেছারত দাদা আবার হাঁক দিলেন, কী রে? তোরে আসতে বললাম না? 

আমি ধীর পায়ে এগোনো শুরু করলাম। কাছে গিয়ে দেখি উনার হাতে একটা দা। আমারে কেটে কুটে খেয়ে ফেলবে না তো আবার? জাহান্নামি মানুষ, খাইতেও পারে। 

উনি ডেকে বললেন, ডাব খাবি? আমি মাথা নাড়ি। যদিও মনে মনে খেতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু আম্মুর কড়া নির্দেশ, অন্য কেউ কিছু খাইতে দিলে শুরুতেই খাওয়া যাবে না। বেশি জোরাজুরি করলে তখন আবার নিতে হবে। তখন না নেওয়াটা বেয়াদবি।

নেছারত দাদা কোন জোরাজুরি করলেন না। ডাবটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ঐ যে লোকটা দেখছিস, বসে আছে গাছের নিচে? ওরে যাইয়া ডাবটা দিয়া আয়। আমি যে দিয়েছি, বলবি না। 

আমি ডাবটা বুকের সাথে আটকে ধরি। তারপর সেই লোকটার সামনে যাইয়া বলি, নেন, ডাব খান। 

লোকটার পাশে একটা লাল রঙের ঝোলা। দেখে বুঝলাম, ফকির। উনি ডাবটা এক চুমুকে শেষ করলেন। তারপর আমার মাথায় হাত দিয়ে দুআ করলেন, আল্লাহ তাআলা রোজ হাশরের দিন তোমার পিপাসা দূর করুক বাবা!! 

আমার লজ্জা লাগে। কারণ, ডাবটা আসলে দিয়েছে নেছারত দাদার। বাট জাহান্নামী মানুষের জন্য দুআ কোন কাজে লাগে নাকি? কে জানে!! 

২. 
এতোদিন আমি জানতাম, ঈদ সবার। 

কিন্তু আজকে জানলাম, ঈদ শুধু রোজাদারদের। 

মসজিদ কমিটির মিটিং। এই মিটিং থেকেই ঈদের জামাত কখন হবে, কটায় হবে ঠিক করা হয়। যদিও মিটিংটা বড়দের, বাট আমরা ছোটরাও বিপুল উৎসাহে সেই মিটিং এর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করি। সাড়ে আটটায় নামাজের কথা উঠতেই মুয়াজ্জিন না না করে উঠলো। আহলে হাদিস হয়েও এতো পরে নামাজ পড়লে হানাফীদের সাথে আমাদের পার্থক্য থাকলো কী? তারচে চলেন, আমরাও হানাফী হয়ে যাই? 

আমি তখন আহলে হাদিস হানাফি বুঝি না। শুধু বুঝি নামাজ যত দ্রুত শুরু হয়, ততই মঙ্গল। আমরা ছোটরা হঠাৎই কট্টর আহলে হাদিস হইয়া উঠি। 

জব্বার দাদা প্রস্তাবটা রাখলেন। যারা যারা রোজা থাকেনি, তাদের ফিতরা আমরা নেবো না। তাদের সাথে এক ঈদগাহে নামাজও পড়বো না। 

শুনে আমি আতকে উঠলাম। মনসুর দাদা পিঠে কিল মেরে অভয় দিলো, আরে গাধা, ছোটদের জন্য এই নিয়ম নাই। 

পরে বুঝেছিলাম, নিয়মটা ছিলো নেছারত দাদার জন্য। 

মাইকে ঘোষণা করা হলো, যারা যারা রোজা রাখে না, তাদের তাদের ঈদগাহে আসার দরকার নাই। 

রোজা এই পাড়াতে একজনই রাখে নাই, সেইটা সবাই জানতো। 

মাইকে ঘোষণা শোনার পর মুরব্বিদের মুখে আমি চাপা আনন্দ দেখি। জাহান্নামী লোকজনের সাথে না মিশতে হলে সেটা আনন্দের ব্যপারই বটে। তবে আমার কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করলেই শুনি, এই সাদিক, ডাব খাবি? 

৩. 
আমাদের মসজিদের ইমাম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো খুব ঢাক ঢোল পিটিয়ে। 

আবার ইমাম বিদায় করেও দেওয়া হলো ঢাক ঢোল পিটিয়েই। 

সালিশ ডেকে রীতিমত অপমান করে ইমাম সাহেবকে বের করে দেওয়া হলো। তার অপরাধ ছিলো, তিনি ফারুক মামার বিরুদ্ধে গীবত করেছেন। অপবাদ দিয়েছেন। ফারুক মামা নজরুল নানার ছেলে। ক্ষমতাবান মানুষ। তার বিরুদ্ধে ইমাম সাহেব কোন অপবাদ দিয়েছিলেন, আমি তখনও বুঝিনি। 

তবে কানাঘুষা শুনে যতটুকু বুঝেছিলাম, ফারুক মামাকে নাকি আজাদ কাকার বৌ এর ঘর থেকে রাতের বেলা বের হতে দেখা গেছে। ইমাম সাহেব ঐটা দেখে ফেলেছিলেন।  

আম্মুদের ফিসফিস করে এটা নিয়ে কথা বলতে শুনতাম। কিন্তু আমরা ছোটরা গেলেই তারা এই বিষয়ে কথা অফ করে দিতো। কাজেই, বিস্তারিত তেমন কিছু জানি না। 

তবে সালিশটা প্রকাশ্যেই হয়েছিলো। স্পষ্ট মনে আছে, ইমাম সাহেব নজরুল নানার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। চাকরি বাঁচানোর জন্য। বয়স্ক একটা মানুষের এমন হাউমাউ কান্নার দৃশ্য দেখে পাথর গলে, তবে নজরুল নানার হৃদয় গললো না।

ইমাম সাহেব গাটকি বোচকা নিয়ে বাইরের বরই গাছের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। নজরুল নানার উপর কথা বলার কেউ ছিলো না। 

তবে কথা না শোনার মতো একজনও ছিলো। 

নেছারত দাদা সন্ধ্যার ঠিক আগে ইমাম সাহেবকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। এরপর মাস দুয়েক ইমাম সাহেব তার বাড়িতেই ছিলো। 

অবশ্য জাহান্নামী মানুষের বাসায় থাকা যাবে কি না, এটা নিয়ে ইমাম সাহেবকে আমি কোনদিন কিছু বলতে শুনিনি। 

৪. 
আমার নিজের দাদাকে আমি কোনদিন চোখের দেখা দেখিনি। 

দাদার স্মৃতি বলতে আমার কাছে ছিলো ঝোপঝাড় ওয়ালা একটা কবর। ছোটবেলা থেকেই গোরস্থান আমি ভয় পাই খুব। খালি, দাদার কবর চেনার পর থেকে আর ভয় লাগে না। মনে হয়, এখানে তো আমার দাদা আছে, আমারে কে কী করবে? 

ঈদের খুতবায় নতুন হুজুর বললেন, জান্নাতি মানুষের কবরে অদ্ভুত সুন্দর সাদা রঙের একটা ফুল ফোটে। 

নামাজ শেষে আব্বুর সাথে দাদার কবর জিয়ারতের সময় আতিপাতি করে খুঁজেও আমি সাদা ফুল দেখতে পাই নাই। তবে কি আমার দাদার জান্নাত নসিব হয় নাই? আমি আব্বুর দেখাদেখি বিড়বিড় করি, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বানি ইয়ানি সাগিরা....

৫. 
ঈদের দিন সবার বাড়িতে হয় আনন্দ। 

আর নেছারত দাদার বাড়ি থেকে ভেসে আসে চিৎকার, চেচামেচি। 

বুবু মুখ চেপে হাসে। বড় আব্বার কন্ঠে ভালো মানুষের অহংকার, রহমত জিনিসটা আল্লাহ সবার ঘরে দেন না। আল্লাহর সাথে নাফরমানির ফল ভালো হয় না। 

আমার বড় আপুর কথা মনে পড়ে। বিয়ের সময় বড় আব্বা জামাইকে বাইক ফ্রিজ উপহার দেওয়ার পরেও বড় আপু এখন আমাদের সাথে থাকে। তিনিও কি নাফরমান? আমি জানি না। শুধু জানি, আপুর মতো সুইট মানুষ আমি এই পৃথিবীতে আর একটাও দেখিনি। 

ঝগড়া গন্ডগোল দেখা সবসময়ই আনন্দের।

ঈদের দিন সেই আনন্দ বেড়ে গেল বহুগুণ। আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে নেছারত দাদার ঘরের ভাঙচুর দেখতে লাগলাম। 

কাহিনী আর কিছু না। দাদা কোথা থেকে জানি তিনটা সাঁওতাল ছেলে মেয়েকে ঈদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই দেখে দাদি চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। সাঁওতাল মেয়েটা কাচুমাচু হয়ে এক কোণায় বসে আছে। 

দাদা শেষপর্যন্ত চাল ডাল মাংস নিয়ে নিজেই রান্না শুরু করলেন। ওদের না নিয়ে উনি খাবেন না। 

পুরো গ্রামে সাড়া পড়ে গেল। নজরুল নানা বললেন, যার সাথে যার উঠাবসা, তার সাথেই তার হাশর নাশর হবে। 

৬. 
মামুন ভাই মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর আমরা অবাক হইনি। 

আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলে তার নাম একটা বোর্ডে লিখে রাখা হয়। 

মামুন ভাইয়ের নাম ওখানে সবার উপরে লেখা ছিলো। হেডস্যারের রুমে গেলে আমরা ঐ নামের দিকে হিংসার চোখে তাকাইয়া থাকতাম। 

সেই মামুন ভাইয়ের ভর্তির টাকা জোগাড় হলো না। নজরুল নানা বললেন, ইচ্ছা করলে টাকা দিতেই পারি। তবে কতদিন? ভর্তির পরেও মেডিকেল পড়ার অনেক খরচ আছে। তোমার ছেলেকে বরং অনার্স পড়াও। 

গ্রামের মানুষও আর সামনে আগালো না। নজরুল নানা গ্রামের মাতবর। তার উপর কথা বলার সাহস কারো ছিলো না। 

তবে শেষপর্যন্ত মামুন ভাই মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন। কীভাবে হয়েছিলেন, টাকা কোথায় পেয়েছিলেন, কেউ জানে না। 

শুধু মেডিকেল ভর্তি হওয়ার ঠিক পরদিন নেছারত দাদার তিন বিঘার আম বাগানটা নজরুল নানার হয়ে গেল। 

নেছারত দাদার শেষ সম্বল বিক্রি হয়ে যাওয়াতে সবাই হাহা করতে লাগলো। 

বড় আব্বা বললেন, বরকত। আল্লাহ তাআলা নজরুলের নসিবে বরকত রেখেছে। নেছারতের নসিবে রাখেনি। নামাজ কালাম না পড়া মানুষের বরকত থাকবে কী করে? 

যদিও শেষপর্যন্ত নেছারত দাদা নামাজ পড়েছিলেন। 

৭. 
সেবার রমজানে আমি ফুল মাস রোজা রাখা শুরু করি। 

তবে তারচেয়েও অবাক করা ব্যাপার, নেছারত দাদা মসজিদে নামাজ পড়া শুরু করে। 

একেকজন অবশ্য একেক কথা বলতো। বয়স হয়েছে, এখন মানুষের যাকাতের টাকার জন্য মসজিদে আসছে, এমন কথাও শুনেছিলাম। 

কেউ কুরআন পড়লে পাশে গিয়ে বসতেন। শুনতেন। এইটাও যাকাত খাওয়ার জন্য করেছিলেন কি না, আমি জানি না। 

তবে একদিন নামাজ পড়তে পড়তে হুট করে উনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। জ্ঞান ফেরার পর মসজিদ ছাড়লেন না। বাকি নামাজটা পড়লেন চেয়ারে। 

তবে এরপর উনাকে আমরা আর মসজিদে দেখিনি। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন ।

৮. 
রমজানের শেষদিকে এসে রোজা ২৯ টা হবে নাকি ৩০ টা, সেই তর্ক চরমে উঠলো। 

সবার জোর ধারণা, রোজা এবার ২৯ টাই হবে। আগের তিন বছর টানা ৩০ টা হয়েছে। 

আম্মুরা মশলা বাটা, সেমাই বানানো শুরু করলো। 

মশলা শুধু হলো না নেছারত দাদার বাড়িতে। দাদা বললেন, রমজান ২৯ না, ৩০ টাই হবে। আমাকে না নিয়ে এই রমজান যাবে না। তোমারা আমাকে শাওয়ালের চাঁদ উঠার আগেই মাটি দিও। 

আব্বু বললেন, সব বুজরুকি। 

নজরুল নানা বললেন, দুইদিন নামাজ পড়েই নেছারত এখন পীর হতে চায়!! 

৯.
বড় নানাদের ছাদ আতিপাতি করে খুঁজেও আমরা কোন চাঁদ পেলাম না। 

পরদিন বিকেলে নেছারত দাদা মারা গেলেন। 

তিনটার দিকে হইচই শুনে আমরা উনাদের বাসায় দৌড় দিলাম। আমাদের চোখের সামনে লা ইলাহা পড়তে পড়তে দাদা মারা গেলেন।

মাটি দেওয়ার তোরজোর শুরু হলো। এতোদিন উনার কথা কেউ না শুনলেও আজ শুনলো। মরা মানুষের কথার দাম এখানে জীবিত মানুষের চে বেশি। 

দাদাকে মাটি দিয়ে এসে আমরা ইফতার করলাম। 

১০. 
অন্য সময় হলে, রমজানে কেউ মারা গেলে তার সম্মানে ইমাম সাহেব কথা বলতেন। কালিমা পড়তে পড়তে কেউ মারা গেলেও সবাই তাকে হিংসা করতো।

তবে নেছারত দাদার বেলায় সেটা হলো না। 

বরং মানুষ আফসোসই করে গেল। নাফরমানির সারাজীবন কি আর ১৫ দিনের নামাজ আর কালিমা দিয়ে শোধ করা যায়? 

নজরুল নানা বললেন, কালিমা তো মুনাফিকরাও পড়তো। আমলটাই বড় কথা। 

নেছারত দাদার জন্য আমাদের মসজিদে কখনওই কোন দুআ হয় নাই কোনদিন। 

১১. 
ঈদের নামাজে আমার কাছে সবচে মজা লাগতো তাকবীর। 

নামাজে আমার মন থাকতো কম। আমি মনের আনন্দে তাকবীর গুনতাম। আরো বেশি তাকবীর কেন হলো না, নামাজ শেষে সেইটা নিয়ে খুব দুঃখ হতো।।

কোলাকুলির পর্ব সেরে আব্বুর হাত ধরে গোরস্থানে গেলাম। 

আব্বু সূরা ফাতিহা, ইখলাস আর দরুদ শরিফ পড়তে লাগলো। আরো অনেক মানুষ জোরে জোরে দুআ পড়ছে, গোটা গোরস্থান পরিণত হয়েছে এক মিলনমেলায় । 

আমি মোনাজাত ধরি। 

আব্বুর চোখে পানি। মুখে পড়ে, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা....

আমি দাদার কবরের দিকে তাকাই। ঝোপ জঙ্গলে অন্ধকার হয়ে আছে। ভেতরটা ভালো করে দেখা যায় না। তবুও আপন আপন লাগে। ওখানেই তো শুয়ে আছে আমার দাদা। 

ডানে নেছারত দাদার কবরটা তখনও বাধাই করা হয়নি। বেড়া দেওয়াও হয়নি। সারা রাতের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে উপরের লাল মাটি। সমতল বানিয়ে ফেলেছে কবরের উপরেরটাকে। 

সেই সবুজ সমতলে ফুটে আছে অদ্ভুত সুন্দর একটা সাদা রঙের ফুল। 

#SehriTales_Day_25
#Sadiqur_Rahman_Khan 
#Ramadan_2024



Post a Comment

0 Comments