ডাল, ভাত আর ডিম ভাজি পছন্দ জেনে রাতুল আমাকে জিগাইসিলো, কেন তুই আর ভালো কিছু খাসনি?
আমার বিব্রত লাগে। কিছুটা অপ্রস্তুতও। রাজশাহী শহরে দুই বছর পড়েছি। থাই, চাইনিজ বা ইন্ডিয়ান মোটামুটি ভালোই খাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও, ডাল ভাত আর ডিম ভাজির স্বাদটা আমি আর কোথাও পাইনি।
রাতুল মুখ টিপে হাসে।
বলে, রাজশাহীকে কেউ শহর বলে নাকি? ঐটা তো গ্রাম। আয় তোকে ঢাকার রেস্টুরেন্টে খাওয়াই। তাও বাপ প্লিজ লাগে, এই ডাল ভাতের গল্পটা আর কাউকে বলিস না। হাজার হলেও তুই আমার রুমমেট। বন্ধু। দিনশেষে কথা আমারও শোনা লাগবে।
রাতুলের সাথে আমি ঢাকার কাচ্চি ট্রাই করি প্রথমবারের মতো। সাথে রেজালা আর বোরহানি। আসলেও রাজশাহী শহরের কাচ্চির সাথে ঢাকার কাচ্চির তফাতটা অনেক বেশি।
খেতে খেতে রাতুল বলে, কী? ডাল ভাতের কথা মাথা থেকে গেছে না? সমস্যা নাই, চলে যাবেনে। থাক কিছুদিন। ঠিক ঠিক জাতে উঠে যাবি।
আমি ডাল ভাতের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। ফেলে খাওয়াতে মন দিই।
২.
প্রথমদিন ক্লাসে গিয়ে আমি অর্ককে সালাম দিয়েছিলাম।
এবং সেইটা নিয়ে এক পিরিয়ড না, দুই পিরিয়ড না, চার চার পিরিয়ড ধরে হাসাহাসি চললো। রাতুল পাশ থেকে বললো, তুই কি মাদরাসার স্টুডেন্ট ছিলি নাকি? তরু বললো, গায়ে একটা জোব্বা লাগাইয়া আসলে পারিস। মাথায় পরবি লাল রুমাল। কথা বলবি আরবিতে।
সবাই হো হো করে হাসে।
এইবার আমাকে পাশে নিয়ে ডেকে বোঝায় সবুজ। দ্যাখ, বন্ধুদের কেউ সালাম দেয় নাকি? এইটা তো গ্রাম না, এইটা শহর। এইখানে এসে গুড মর্নিং বলবি। হোয়াটসাপ বলবি। সালাম তো দেবে বুড়ো মানুষ আর গ্রামের মুরগি পোলাপাইন। তুই কি মুরগি?
আমি মাথা নাড়াই। তাই তো।
সালাম দেওয়ার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই ছিলো। দাদি শিখিয়েছিলো, এক সালামে নব্বই নেকি। আচ্ছা, গুড মর্নিং বললে কি নেকি পাওয়া যাবে?
দাদিকে জিগাইতে পারলে ভালো হতো।
৩.
আমার উত্তর শুনে হাবিবুর স্যার চোখ কপালে তুললেন। বললেন, বাসা কোথায়? চাপাই নবাবগঞ্জ?
আমি বললাম স্যার রাজশাহী।
স্যার বললেন, ইউনিভার্সিটিতে কেন আসছো?
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। ইউনিভার্সিটিতে মানুষ যো পড়তেই আসে, কেন আসবে আর?
হাবিবুর স্যার বললেন, উহু, ইউনিভার্সিটিতে মানুষ আসে সভ্য হতে। স্মার্ট হতে। তুমি এখানে কথা বলতে আসছো। গান গাইতে আসো নাই। তোমার কথার মধ্যে যদি রাজশাহীর টান থেকেই থাকে, তবে আর ইউনিভার্সিটিতে পড়ার দরকার কী? ওখানের কোথাও পড়লেই পারো?
আমি মাথা নাড়াই। কথা তো ভুল বলে নাই।।
হাবিবুর স্যার থামেন না। বলেন, মা বাবার থেকে কিছু পেয়েছ বলেই সেটা ভালো, ধরে রাখতে হবে, এমন ধারণা গোড়ামি। তোমরা গোড়া হবে না, ওপেন মাইন্ডেড হবা। নিজেকে আপডেট করবা। ডেভেলপ করবা।
আমি হাবিবুর স্যারের কথা মেনে নিই।
ইউটিউব দেখে দেখে ভাষার উচ্চারণ শিখি। নিজের কথা রেকর্ড করে নিজেই শুনি। ভুল খুঁজে খুঁজে বের করে আমি কিছুদিনের মধ্যেই প্রমিত বাংলা আয়ত্ত করে ফেলি।
হাবিবুর স্যার আর কোনদিন কথা শুনে আমার হোমটাউন জিজ্ঞেস করেননি।
৩.
আমার পছন্দের বইয়ের নাম মাসুদ রানা জানার পর মাইশা আমার সাথে কথা বলেনি তিনদিন।
শুধু একটা কথাই বলেছিলো, আপডেট হও, সাদিক। নিউজপ্রিন্টে ছাপানো সস্তা বিনোদন পড়ে মেন্টালিটিকেও তো সস্তা বানিয়ে রেখেছ? মার্কেজ পড়ো, মুরাকামি পড়ো, জীবনানন্দ পড়ো।
কিন্তু আমার যে পড়তে ভালো লাগে না?
পচা খাবার খেয়ে খেয়ে অভ্যাস করলে এমন তো হবেই। টাইম নাও। পারলে তো ভালোই। না পারলে আমাদের রিলেশন নিয়েও ভাবতে হবে। ডিনারের পর হান্ড্রেড ইয়ার সল্যিচুড নিয়ে কথা বলার শখ আমার অনেকদিনের। তুমি মাসুদ রানার মতো বস্তাপচা জিনিস পড়লে তোমার সাথে মার্কেজ নিয়ে আড্ডা দিবো কীভাবে?
আমি টেবিল থেকে মাসুদ রানা সরিয়ে ফেলি। কী নোংরা নিউজপ্রিন্টে ছাপানো সস্তা বই । ছি।
এভাবেই একদিন টেবিল থেকে সরিয়েছিলাম আমার প্রিয় বেলি ফুলের গন্ধওয়ালা পারফিউম। সরিয়ে ছিল বাসা থেকে আম্মুর ওড়নায় জড়িয়ে আনা কুরআন শরীফটাও।
মাইশাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আর ভালোবাসার মানুষের জন্য তো চেঞ্জ হওয়াই যায়, নাকি?
আমি মুরাকামির কাফকা অন দ্য শোর বুকে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। পড়ার বদলে চোখে লেগে আসে ঘুম।
৫.
থার্ড ইয়ারে গিয়ে হাবিবুর স্যারের কথামতো আমি পুরোপুরি স্মার্ট মানুষ হয়ে গেলাম।
রাতুলরা আমাকে নিয়ে আর মজা নেয় না। আমি এখন ঘন্টার পর ঘন্টা ওদের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ বা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ নিয়ে কথা বলতে পারি।
মাইশার কথা মতো আমি এখন গোল গলা ঢিলা টি শার্ট পরি না। সবসময় টিপটপ থাকি।
এখন আর কেউ প্রিয় শিল্পীর নাম জিগাইলে এন্ড্রু কিশোর বা সুবীর নন্দির নাম বলি না। হ্যা, আমিও এখন জন ডেনভার, বব ডিলান আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শিখে গেছি।
বেলি ফুলের স্মেলওয়ালা পারফিউমটা ফেলে দিয়েছি। লরেন ব্লু এখন আমার পছন্দের পারফিউম। গায়ে দিলেই ক্লাসি ক্লাসি একটা ভাব চলে আসে।
এর মধ্যে মাইশা একদিন বলে, বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি তোমারে নিয়ে অনেক হ্যাপি, আমি তোমারে নিয়ে অনেক প্রাউড, সাদিক।
আমি ওর চোখে আরো কিছু বলি। হাতের উপর হাত রেখে বলি, কিছু বলবা?
মাইশা বলে, আই নো, তুমি তোমার ক্লাসের ডিফারেন্সটা দারুনভাবে ওভারকাম করেছো। গ্রামের ছেলে এখন আর নাই তুমি। বাট, তোমার নামটা...আই মিন নামের শেষ অংশটা যদি একটু চেঞ্জ করা যেত...ইউ নো, আলী নামটা এই যুগে একদমই যায় না। বাকি নামটা ওকে, জাস্ট আলীটা সরিয়ে দিলেই হবে।
আমি ওরে অভয় দেই। পাগলি মেয়ে। এতো ইতস্তত করার কী আছে? ঠিকই তো আছে, আলী নামটা আমার নিজেরও পছন্দ না। চলো, এভিডেভিট করে আসি।
আমরা দুজন মিলে এফিডেভিট ফর্ম নিই। উপরের বক্সে আগের নাম কেটে নতুন নাম লিখে দিতে হবে।
আমি মাইশাকে বলি তুমিই করে দাও, এ আর এমন কী? মাইশা বলে, না না, ও কী কথা। তুমিই কইরো।
আমি ফর্মটা নিয়ে আমার রুমে চলে আসি।
৭.
আলী শব্দটা কাটার সাথে সাথে আমার বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। আমি বুক চেপে ধরে শুয়ে পড়ি।
রাতে ঘুম ভেঙে গেলে গলার কাছটা শক্ত শক্ত লাগে। হাত দিয়ে দেখি, একটা শক্ত লোহার শেকল আমার গলা পেচিয়ে ধরে আছে।
আমি তড়িঘড়ি করে শিকল খুলতে যাই।পারি না। আরো বেশি চেপে বসে গলায়।
আমি কি মারা যাচ্ছি?
আমার মনে পড়ে বাবার মুখ। মনে পড়ে মায়ের হাতের ডিম ভাজি, আলু ভর্তা আর ডালের কথা। আহারে!! শেষ বেলায় যদি একবার খেতে পারতাম!!
আমি কথা বলতে যাই। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। বের হয় মেকি কিছু ইংরেজি ওয়ার্ড। আমার মনে পড়ে, রাজশাহীর ভাষা বের হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিন বছরে আমি কোনদিন মন খুলে কথা বলতে পারিনি।
আমার গা থেকে হুট করে মাটির গন্ধ আসে। আমি রালফ লরেনের বোতল গায়ে ঢেলে দিই। আমা সারা গা পুড়ে যায় সভ্যতা আর আধুনিকতার আগুনে। আমি চিৎকার করে উঠি।
আমি পানির বোতল হাতে নিয়ে পানি ঢালতে শুরু করি গায়ে। শান্তির একটা পরশ বইয়ে যায় আমার শরীরে।
চোখের সামনে পানির বোতলটা হয়ে যায় মাসুদ রানা, হয়ে যায় এন্ড্রু কিশোরের গান, হয়ে যায় বেলি ফুলের সেই মন মাতানো গন্ধ।
আমার এবার শান্তি শান্তি লাগে।
মুখে হাত দিয়ে চমকে উঠি। আমার মুখের চামড়া এতো শক্ত হলো কীভাবে?
আয়না দেখে হতভম্ব হয়ে যাই।
আমার মুখে কোন চামড়া নাই। চামড়ায় জায়গায় শক্ত লোহার মুখোশ আটা। খুলতে চেষ্টা করি। পারি না।
৮.
পরদিন সকালে উঠে আমি এভিডেভিট এর ফর্মটা ছিড়ে ফেলেছিলাম।
প্লে লিস্ট থেকে ফেলে দিয়েছিলাম জন ডেনভার,বব ডিলান আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। আবারও প্লে স্টোর ফুল করে ফেলি আসিফ আর এন্ড্রু কিশোরের বাংলা গানে।
টেবিল থেকে ফেলে দেই লিও তলস্তয়, মার্কেজ আর মুরকামির জঞ্জাল। আবারও ব্যাগে তুলে নিই সস্তা নিউজপ্রিন্ট কাগজের মাসুদ রানা।
গোল গলা টি শার্টটা বেশ আটোসাটো হয়। তবে আমার বেশ ফুরফুরা লাগে। মনে হয় আমি একটা পাখি।
আমি চুলে কড়া করে সরিষা তেল দিই। সিথি করে চুল আচড়াই। রাতুল আমাকে দেখে হা হয়ে যায়, কিছু বলতে পারে না।
ততক্ষণে আমার গা থেকে আসতে শুরু করেছে সেই আগের সোদা মাটির গন্ধ। আমি আরমানির বোতলটা ডাস্টবিনে ফেলে দিই। গ্রামের ছেলে আমি, আমার গায়ে বরং মাটির গন্ধই থাকুক।
আমি মায়ের ওড়নায় জড়ানো কুরআন শরীফটা টেবিলের উপরের তাকে রেখে দিই। চুমু খাই। আম্মু সবসময় খেত। আমার মনে পড়ে দাদির সেই সুর করে কুরআন পড়ার দৃশ্য, ফাবি আয়্যি আলা ঈ রাব্বিকুমা তুকাযযিবান। বহুদিন পর, আমি দাদির মতো সুর করে কুরআন পড়তে শুরু করি।
আমার ভয়ঙ্কর ভালো লাগে। খোদা, মা আর দাদিরে মনে হয় আমার খুব কাছের ।
রাতুল পাশের বেড থেকে ভূত দেখার মতো করে আমাকে দেখতে থাকে। আমি বলি, চল, আজকে ডাল, আলু ভর্তা আর ডিমভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। কতদিন খাই না, ইশ!!
রাতুল ভয় পাওয়া গলায় কিছু বলতে চায়, পারে না।
আমি ক্লাসে যাইয়া অর্ককে সালাম দিই। রাস্তায় ফয়সাল ভাইকে সালাম দিই। অর্ক আরও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাইয়া থাকে।
আমি বড় বড় করে নামের শেষে আলী লিখি। তারপর খাতাটাকে জড়িয়ে ধরি বুকের সাথে। খাতার মধ্যে আমি বাবা গন্ধ পাই।
৯.
মাইশা রাগ করে বলেছিলো, তোমাদের জাতটাই আসলে এমন। তোমার চাচা তো কৃষক, না?
আমি বলি, হ্যা, আমার চাচা কৃষক। উনাদের চারটা গরু আছে। ছোটটার নাম বুধা। বুধার চোখ দুইটা অনেক সুন্দর। তোমার চাইতেও বেশি।
মাইশা দাঁত কিড়মিড় করে বললো, তুই ঐ গরুর সাথেই সংসার কর। কারণ, ইউ ডিজার্ভ ইট।
আমার জীবন থেকে ধীরে ধীরে মাইশা, রাতুল, অর্ক, কাঞ্চন বিদায় নিতে শুরু করে। আমার একটুও খারাপ লাগে না। বরং ভালো লাগে। তাদের জায়গায় চলে আসে মাসুদ রানা, এন্ড্রু কিশোর আর ডিমভাজি ভাত।
আমার ক্লান্তি কেটে যেতে থাকে। অদ্ভুত এক আরামে ছেয়ে যায় শরীর আর মন। ঐ আরামে আমি মায়ের ছোয়া পাই।
রাতে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাসুদ রানা পড়ি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, এতো আরাম মাইশাকে চুমু খেয়েও কোনদিন পাই নাই আমি।
রাতর বেলা হুট করে আয়নায় চোখ পড়ে।
সেই নাক, সেই চোখ, সেই কপাল, সেই চুল। কিছূটা মলিন, তবে এক্কেবারে জেনুইন। সবটাই আমার নিজের।
আমি হাত দিয়ে চেহারা স্পর্শ করি।
না, আজ সেখানে কোন মুখোশ নাই।
#SehriTales_Day_13
#Sadiqur_Rahman_Khan
#Ramadan_2024
0 Comments