"বি ফাইভ"



ক্যাম্পাসে আমাদের সার্কেলটাকে সবাই বলতো পঞ্চপান্ডব। 

আমরা নিজেরা ডাকতাম বি-ফাইভ। 

এই বি মানে ব্রিলিয়ান্ট না, এই বি মানে ব্রাদার। আমরা নিজেকে বন্ধু ভাবতাম কম, ভাই ভাবতাম বেশি। কলেজের বাতাস ততদিনে গা থেকে চলে গেছে পুরোপুরি। শেষ হয়েছে ফার্স্ট ইয়ারের হানিমুন পিরিয়ডও। কাজেই, বোঝাই যাচ্ছিলো, এই সার্কেলটা শেষপর্যন্ত ওয়ার্কআউট করতে যাইতেসেই। 

আমাদের মধ্যে মাহিদ ছিলো অসাধারণ মিউজিশিয়ান। অর্ক আবার ছিলো মারাত্মক ভালো স্টুডেন্ট। হারুন ছিলো জাত প্লেয়ার, কী মাঠে, কী খাটে। তালহা আবার ছিলো তাবলীগ করা ছেলে। ধরে ধরে নামাজ পড়তে নিয়ে যেত। 

কাজেই, কম্বিনেশনটা ছিলো ডাইভার্সিফাইড। যেমন বলা হয়, ভার্সিটিতে ফ্রেন্ডশিপ হয় শুধু স্বার্থ দেখে, এমন কিছু আমাদের মধ্যে ছিলো না। কারণ আমরা একেকজন ছিলাম একেক জগতের মানুষ। 

শুধু একটা জায়গাতে এসেই আমরা এক হতাম, সেটা হলো বন্ধুত্ব। 

২. 
মিড পরীক্ষায় আমাদের ডিপার্টমেন্টে কখনোই সিট ফেলা হতো না। 

আমাদের ঢুকতে হতো গ্যাঞ্জাম করে। এই গ্যাঞ্জাম সহজ গ্যাঞ্জাম না, বরং এই গ্যাঞ্জাম ছিলো কঠিন গ্যাঞ্জাম। এরে ধাক্কাও, ওরে ধাক্কাও। কারণ ঢোকার সময় সবাই টার্গেট থাকতো পেছনের বেঞ্চ। 

এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যেও আমরা ৫ জন একসাথেই ঢুকতাম। একসাথে বসতাম। ক্লাসে গেলে একসাথে যেতাম। আবার ক্লাসে না গেলে কেউ যেতাম না। পুরাই স্কুল কলেজ লেভেলের ফ্রেন্ডশিপ যাকে বলে। 

একবার আমাদের এক বান্ধবী ফেসবুকে লিখলো, ইউনিভার্সিটি লাইফে কোন বন্ধু নাই, সবাই সাপ। আমরা ৫ জন ওকে ধুয়ে দিয়ে আসলাম কমেন্টে। তবে মাহিদ বললো, এভাবে হবে না। চল আমরা সবাই এক কালারের টি-শার্ট বানাই। টি শার্টের উপরে লেখা থাকবে বি-ফাইভ। পেছনে লেখা থাকবে ফ্রেন্ডস ফরএভার। 

আমরা টি-শার্টের কালার ঠিক করতে বসি। ডিজাইন করে অর্ক। আমরা এক কালারের টি শার্ট পরে ক্যাম্পাস দাবড়ে বেড়াই। সবাই উপরে উপরে আমাদের দেখে হাসে, বাচ্চামি বলে। বাট ভেতরে ভেতরে সবাই যে জেলাস, সেটাও আমরা বুঝি। 

যে কোন পার্টিতে, যে কোন প্রোগ্রামে আমরা থাকি একসাথে। সিনিয়ররা নাক সিটকায়, বলে, কত দেখলাম অমন!! দুই দিন যাক, সব বাপ বাপ করে পালাবে!! দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বাপ বাপ করে কিছুই পালায় না। 

এর মধ্যেই হারুনের জন্মদিন চলে আসে। আমরা সারপ্রাইজ প্ল্যান করতে বসি। 

৩. 
হারুনের জন্মদিন হয়েছিলো দেখার মতো। 

আতশবাজি, ফানুশ আর গিটার মিলিয়ে পুরা হল জেনে গেল, আজ কারো জন্মদিন। 

জুনিয়ররা এসে লাফালাফি শুরু করলো। পানি ছিটাছিটি শুরু করলো। 

গিটারিস্ট মাহিদ গিটার নিয়ে রেডি। অর্ককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফটোশ্যুটের। আমি গিয়ে হারুনকে ডেকে নিয়াসলাম। আয়োজন দেখে হারুন আনন্দে কেদে ফেললো। এমন করে কোন জন্মদিন নাকি ওর ফ্যামিলিও কখনো করে নাই। 

শুনে আমি ওর মাথায় চাটি মারি। ধুর গাধা, ফ্যামিলি না করলে আমরা কে? আমরা কি তোর ফ্যামিলির বাইরে? 

হারুন আবেগে আমাদের জড়িয়ে ধরে। বলে তোরা আমার ভাই। আসলেই তোরা আমার ভাই। 

অর্ক এসে সেলফি নেয়। গোটা হলের পোলাপাইন সেই সেলফিতে চলে আসে। তবে আমরা ৫ জন আলাদা। কারণ, আমরা তো বন্ধু না, আমরা হলাম ভাই। 

রাতের বেলা আমি ওর জন্য কিনে রাখা গিফটের প্যাকেটটা দিয়ে দিই। এই প্রথম কোন বন্ধুর জন্য আমি এতো দাম দিয়ে গিফট কিনেছি। খুব গর্ব হয়। ইশ, এই ফ্রেন্ডশিপ যেন আমাদের সারাজীবন থাকে!! 

৪. 
হারুনের জন্মদিনের পরদিন ফোর্থ ইয়ারের এক বড় ভাই বলেই ফেললেন, আজ চার বছর ধরে হলে আছি, অথচ আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে হ্যাপি বার্থডেও বললো না। সারপ্রাইজও দিলো না। তাই তোদের দেখলে কষ্ট লাগে। আবার ভালোও লাগে। 

আমরা শুনে খুশি হই। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়।ভাগ্যিস এমন একটা সার্কেল পেয়েছিলাম এখানে এসে? 

মাহিদ বলে দোস্ত চল ভিডিও বানাই একটা। এতো সুন্দর ফ্রেন্ডশিপ আমাদের। স্মৃতি থেকে যাওয়া উচিত না? আমি বলি, অবশ্যই উচিত। 

একবার ডিপার্টমেন্টের একটা প্রোগ্রামে বন্ধু তুমি শত্রু তুমি নামে একটা প্রোগ্রাম হলো। সুইট টাইপের একটা কম্পিটিশান। বন্ধুর বার্থডে, পছন্দের রঙ বা পছন্দের বই এর নাম বলতে পারতে হবে। পুরো ক্যাম্পাসের মধ্যে আমরা ৫ জন সবগুলো প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠিক দিয়েছিলাম। 

ততদিনে হেটার্সরাও স্বীকার করে নিয়েছে, আমাদের সার্কেল অভেদ্য। এই সার্কেল ভেঙে ফেলা সম্ভব না। 

মাঝেমধ্যেই স্কুল কলেজে কথা মনে হয়। খারাপই লাগে। ইশ, এমন একটা সার্কেল যদি ইশকুলে থাকতো? 

৫. 
মুশফিক ভাইয়ের সাথে ঝামেলাটা বাধলো বিকেলে। খেলার মাঠে। 

ঘটনা সামান্যই। উনি বাইক রেখেছিলেন মাঠের উপর। আমি সরাতে বলেছিলাম। ইগো হার্ট হয়ে গেল। লেগে গেল হাতাহাতি। আমিও ছাড়লাম না। সিনিয়র বলে যা ইচ্ছা করবে নাকি? ক্যাম্পাসে পাওয়ার আমার কম আছে? 

মুশফিক ভাই আমার এলাকার। আমার গ্রামের। আমার স্কুলের। আমার কলেজেরও। তাই বলে আমি ছেড়ে দিবো? অসম্ভব। আমি হাত চালাইয়া দিলাম। 

মাঠের লোকজনের হস্তক্ষেপে গ্যাঞ্জামের প্রাথমিক পর্যায় শেষ হলো, তবে আমি ভালো করেই জানতাম, মূল গ্যাঞ্জামটা হবে আসলে রাতে। আমি মাহিদকে ফোন দিলাম। বললো, কোন টেনশন করিস না। আমরা তো আছি। কে তোর কী করে, আমি দেখবো। আমাদের বন্ধুর গায়ে হাত দেবে, আর আমরা ছেড়ে দেবো? 

গভীর রাতে বিচার বসলো। মুশফিক ভাই পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক। প্লাস অথারিটি জড়িত হয়ে গেসে। মুশফিক ভাই শুরু করলো আমার অপরাধের বিস্তারিত বয়ান। আমি আমার কথা বলতে গেলাম। বলতে দেওয়া হলো না। থামাইয়া দিলো। 

মাহিদ উঠে বললো, আমি তো বিকেলে ছিলাম না। কী হয়েছে ঠিক জানিও না। মারামারি, হাতাহাতি তো ভালো জিনিস না। এক ডিপার্টমেন্টের লোক আমরা। মিটমাট করে নেন। দুইজনই স্যরি বলুক। 

আমাকে অবাক করে দিয়ে হারুন আর অর্কও মাহিদের কথাকে সাপোর্ট দিলো। আর তালহা? ও মিটিং এ আসেইনি। 

আমি লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে স্যরি বলে ঝামেলা মিটালাম। 

সাথে বন্ধুত্বও। 

৬. 
পরে মাহিদ আমাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। দ্যাখ, সামনে বিসিএস দেবো। মুশফিক ভাইয়ের সাথে ঝামেলায় গেলে আমারে পলিটিক্যাল ব্যাকাপ দেবে কে? 

অর্ক বলেছিলো স্যারের কথা। সহকারী প্রভোস্টের কোর্স চলে। কিছু বলে স্যারের কাছে কালার হলে রেজাল্ট নেমে যাবে না? 

তালহার ব্যাপারটা ছিলো ধর্মীয়। তাবলীগের ছেলে হয়ে গন্ডগোল মারামারি করলে লোকে কী বলবে? দুর্নাম হয়ে যাবে না? আর দোষ তো তোরও ছিলো, তাই না?  

আমি শুনে হাসি। 

হিসাব সবাই করেই রেখেছিলো। হিসাব করিনি শুধু আমি।

এবার হিসাব করতে শিখলাম। সাথে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্বের প্রথম পার্টও। 

এখানে জন্মদিন থাকে, বন্ডিং থাকে, ব্রাদারহুড থাকে। সাথে থাকে হিসাবটাও। যার যার স্বার্থের হিসাব। 

যে হিসাবের বাইরে মাহিদ যায়নি। অর্ক যায়নি। তালহা যায়নি। হারুন যায়নি। আমি নিজেও কি যেতাম? কে জানে!!

সময় বদলেছে। তবে মানুষ বদলায়নি খুব একটা। এখনও সেই ঈশপের সময়ের মতোই, বিপদের ভাল্লুক ঘাড়ে না আসা পর্যন্ত আপনি বন্ধু চিনবেন না।

একুশ শতকের পৃথিবীতে ঈশপ কিভাবে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন, না? 

৭. 
আমাদের পাড়ায় দুই মাস অন্তর অন্তর আট টিমের খেলা হয়। ছুটিতে গেলে তখন আমিও খেলি। পুরষ্কার বড়ই চমকপ্রদ। কখনও খাসি। কখনও ভেড়া। 

সেই খাসি পাওয়ার লোভেই হোক আর ন্যাচারাল রিফ্লেক্সই হোক, আমি পা চালাইয়া দিলাম। আমার পা যাইয়া লাগল অপোনেন্টের মুখে। 

খেয়াল করে দেখি, মুশফিক ভাই চোখ মুখ লাল করে আমার দিকে তাকাইয়া আছে। আমি বুঝলাম, আজ আবারও গ্যাঞ্জাম বাধবে। কিন্তু সমস্যা হলো, আজকে আমি একা। 

সন্ধ্যার বিচারে মুশফিক ভাই আমারে শাসায়। বলে স্যরি বলে মাফ চা। তোর বেয়াদবি সীমা ছাড়াইতেসে। আমি জানতাম খেলার মধ্যে ফাউল করা কোন অন্যায় না, তাও আমি স্যরি বলার প্রিপারেশন নিই। আমি ঘরপোড়া গরু, সিদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। 

এমন সময় পেছন থেকে হাসান আগাইয়া আসে, বলে কেন? ও স্যরি বলবে কেন? আপনি খেলার ভেতরের জিনিস নিয়া বাইরে বিচার বসান, আপনার লজ্জা নাই? 

পেছনে আইসা দাঁড়ায় সাগর। আইসা দাঁড়ায় মিলন। তুফান। দ্বীপ। কাহিনী কী? আমার স্কুলের সবাই চলে আসছে নাকি? মিহির আমার কাঁধে হাত রাখে। বলে, ভয় নাই, দোস্ত। আমরা আছি

মুশফিক ভাইয়ের চেহারা কালো হয়ে যায়। বুঝতে পারেন, এইটা ক্যাম্পাস না। 

কেস অমীমাংসিত রেখেই বিচার শেষ হয়। 

না, আমারে এবার আর স্যরি বলতে হয় নাই। 

৮. 
রাতে শুয়ে ঘুম আসতে চায় না। 

চোখ জ্বালা করে। 

ইচ্ছা করে, এই ছেলেগুলারে কিছু দিই। এই ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা নাই আমার, বাট উপহার কিছু তো দিতেই পারি, নাকি? 

বাট হাসানের জন্মদিন কবে? জানি না। তুফানের প্রিয় রঙ কী? জানি না। ওরা কি বই পড়ে? কোন ধরনের বই দেবো? জানি না। 

আমি অবাক হয়ে ভাবি, ওদের সমন্ধে আমি কিছুই জানি না। নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ওরা নিজেরাও আমার সমন্ধে জানে না। এমনকি আমাদের কোন ছবি নাই, ভিডিও নাই, সেইম কালারের টি শার্টও নাই।

অথচ এতো এতো নাই এর মধ্যেও বন্ধুত্বটা যে কোন ফাঁকে দিয়ে থেকে গেছে, কে জানে!!

#SehriTales_Day_07
#Sadiqur_Rahman_Khan 
#Ramadan_2024

Post a Comment

0 Comments