"মেশিন"



বের হওয়ার সময় আম্মু আরো একবার মনে করাইয়া দিলো, আমি কিন্তু আজকে গ্রামে যাবো। 

আমি মুচকি হাসি। বলি, ড্রয়ারে আছে, নিয়ে নিও। 

আম্মু খুশি হয়। বলে, তুই তো আর যাস না কোনদিন। বাপের ভিটার প্রতি তোর দরদ নাই, সাদিক!! 

আমি আম্মুর অভিযোগ মাথা পেতে নিই। কারণ আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এই মাসের ক্রেডিট কার্ডের লোন শোধ এখনও বাকি। মাসের বাকি আছে ১৪ দিন। আমি ঢোক চিপি। 

মানিব্যাগের দিকে তাকাইতে যাইয়াও তাকাই না। ভয়ের জিনিস যত কম দেখবো, ততই মঙ্গল।

২. 
ফারুক আজকাল আমার সাথে কথা বলার সময় গলা উঁচু করে। বেশ কয়েকদিন থেকেই খেয়াল করি। কিছু বলি না। কী ই বা বলার আছে? 

আজ অবশ্য গলা উঁচু করলো না। বরং পানি পানি হয়ে বললো, তরফদারের ফাইলটা স্যার ঠিক করে দিয়েছে। যা যা সমস্যা ছিলো। আজকের মধ্যে সাইনটা স্যার লাগবেই। বেচারি বিপদে আছে। 

নামটা শুনেই আমি সাবধান হয়ে যাই। ফাইলটা আরো ভালো করে দেখা শুরু করি। বড় কোন ঘাপলা না থাকলে কেউ একটা কাজের জন্য তিন লাখ টাকা সাধে না।

একটু খেয়াল করে দেখতেই ঘাপলাটা বুঝতে পারি। যেই স্ট্যাম্পে ডিড করা হয়েছে, ওটা নকল।।কাঁচা হাতের কাজ। আমি লাল কালি দিয়ে ফাইল রেখে দিই। আরো একবার।

ফারুকের মুখের দিকে তাকানো যায় না। সে গজগজ করতে থাকে, নিজে সততা মারাবেন, মারান। আমাদের সাথে নিয়ে মরার তো কারণ নাই। আমার বাপে তো আর জমিদারি রেখে যায় নাই যে মাসের বেতন দিয়ে সংসার চালাবো.....। 

আমি চোখ বন্ধ করি। মাথা হেলিয়ে দিই চেয়ারের পেছনে। 

আমার বাপেরও তো জমিদারি ছিলো না। তাই বলে আমার সংসার কি চলছে না? 

মনে পড়ে, মিলি বলেছিলো সিলিন্ডার শেষ। গ্যাসের দোকানে ফোন করতে হবে। 

আমার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। সংসার কি আসলেও চলতেসে? 

৩. 
বাসায় ঢুকতেই রবিন দৌড়ে এসে গলায় ঝুলে পড়ে। মামা, সারপ্রাইজ!! 

কত বড় হয়ে গেছে, বাহ!! মনে আছে, বছর চারেক আগেও আমার দুই হাত বেঁধে ওর সাথে গরু গরু খেলতে হতো। ঘাস খাওয়ার ভান না করলেই দিতো থাপ্পড়। ওর থাপ্পড়ের ভয়ে আমাদের বাসার সবাইকেই ঘাস খেতে হয়েছে, মিছামিছি ঘাস।

বড় আপু এসে মাথায় হাত রাখে। বলে, সাদিক, এতো শুকাইলি কেমনে? ডায়েট ফায়েট করিস নাকি কিছু? আমাকেও কিছু টিপস দে। আমিও শুকাই। 

আমি রবিনের চুল ধরে টানতে থাকি। বলি, কাজের প্যারাতে পড়লে আর ডায়েট করা লাগে না। এমনি এমনিই চর্বি খসে পড়ে। 

বড় আপু ঠোঁট উল্টায়। এতো বড় অফিসার হইছিস। সারাদিন থাকিস তো এসিতে। এতো আর কষ্ট কিসের? 

আমি চোখমুখ বুজে ভাত খাইতে থাকি ।

আজকের ফাইলের ঘটনা ফারুক না, স্যার পর্যন্ত গেছে। স্যার অনেক গল্পের পরে যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো, ফাইল পাস না করলে বদলি হতে হবে। টাকা নিয়ে করবেন নাকি টাকা না নিয়ে করবেন, সেইটা আপনার ডিসিশন। 

আমার কপালে জমে উঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। 

এক সংসারেই এই অবস্থা, সংসার দুই জায়গাতে হলে আর সামলাবো কীভাবে? 

৪. 
রাতে ঘুমানোর সময় মিলি আমার সাথে রাগ করে। আজকেও সিগারেট টেনেছ? আমি মুখে একটা ভ্যাবলার হাসি দিয়ে বসে থাকি। এই হাসির সামনে মিলি অসহায়, সেই প্রেমের সময় থেকেই দেখছি। 

মিলি কাছে এগিয়ে আসে। বুকের মধ্যে সেটে থাকতে থাকতে বলে, অবনীরে কিন্তু আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়াবো না। তুমি নিজেই তো বলো, বাচ্চাকাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো উচিত। সামনের মাসেই কিন্তু ভর্তি। মাথায় রেখো। 

আমার কপাল আবার ঘামে। মাথায় আমার ভালোভাবেই আছে। ভর্তি হতে লাগবে ত্রিশ হাজারের বেশি। হঠাৎই নিজের উপর রাগ হইতে থাকে। মিলির মাথায় এই ইংলিশ মিডিয়ামের ভূতটা ঢুকাইসি আমিই। 

পাশেই অবনী হাত পা ছেড়ে ঘুমাচ্ছে। ওর মুখ দেখলে আমি জগতের সব কষ্ট ভুলে যেতে পারি, সব।

 ৫. 
ইফতার পার্টিতে সবার চাঁদা দুই হাজার। আমার শুধু ৫ হাজার। 

হাসিবের দিকে চোখ পাকানোর চেষ্টা করি। এতো টাকা নাই তো বাপ। 

হাসিব কোন কথা শোনে না। বলে, হলে থাকার সময় এসব অনেক শুনেছি। এখন আর শুনছি না। বন্ধুদের মতো এতো বড় চাকরি তুইই করস। দে, টাকা দে। ইনকাম কি তোর কম নাকি? 

বলেই, আমারে ও চোখ মারে। 

আমি ওর চোখের থেকে চোখ নামাইয়া নিই। মানিব্যাগ খুলে ৫ হাজার টাকা দিয়ে দিই। 

হাসিব টাকা নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়। আমি ফোনের নোটপ্যাড থেকে চারটা বইয়ের নাম কেটে দিই। আজ ৪ মাস ধরে কাটছি। পরের মাসে কিনবো বলে। 

স্কুলে পড়ার সময় আব্বুর দেওয়া টিফিনের টাকা জমিয়ে বই কিনতাম অনেক। আজ আব্বু নাই, আমার বই কেনাও আর হয় না।  

৬. 
রবিন বলে, মামা আমি ফার্স্ট হয়েছি। 

আমি বলি, সাবাশ বেটা!! 

বড় আপু বলে, তোর মতোই মেধাবী হয়েছে। দোআ করি, তোর মতোই বড় হোক। 

আমি চমকে উঠে রবিনকে আরো জোরে আকড়ে ধরি। না, না, আমার মতো কেন হবে? আমার মতো না হোক। 

বড় আপু বলে, ও কী কথা? এতো বড় সরকারি অফিসার তুই। আরামের চাকরি। তোর মতো হলে সমস্যা কী? 

আমি কিছু বলি না। কী বলবো? 

আম্মু বলে, ও ফার্স্ট হলে আমি ওকে সাইকেল কিনে দিতে চেয়েছি। কালকে ওকে একটা সাইকেল কিনে দিস তো!! 

আমার কপালে আবারও ঘাম জমে উঠে। সাইকেলের দাম এখন, কেমন কে জানে? 

৭. 
রবিনের পছন্দ আর আমার বাজেট শেষমেশ ম্যাচ করলো না। 

ফলে, আমারে আবারও ফোন দিতে হলো হাসানের কাছে। 

যদিও ওর কাছে আমার বিয়াল্লিশ হাজার ধার আছেই, ওটা বরং ৫০ হোক। একবারেই দেবোনে।

হাসান ফোনের ওপাশ থেকে মজা নেয়, কিরে, গাড়ি টাড়ি কিনলি নাকি? হাত খুব টান মনে হচ্ছে? 

আমি বলি, অমনই। 

হাসান হাইসা উঠে, জয়েনের তিন বছরেই গাড়ি? মাল তো মামা তুমি কম কামাওনি। 

আমি চুপচাপ ওর থেকে টাকা নিয়ে কাইটা পড়ি। 

অবশ্য ভুল কিছুও বলে নাই। সাইকেল তো শেষমেশ গাড়ির মধ্যেই পড়ে, নাকি? 

৮. 
ঈদ আসলে সবাই খুশি হয়। 

আমি পাই ভয়। 

তবে এবার ভয় পেয়েও লাভ হলো না। সবার পছন্দের জামা, শার্টের লিস্ট আমার কাছে হাজির হয়ে গেল। 

আমি একবার লিস্টের দিকে তাকাই।আরেকবার তাকাই মানিব্যাগের দিকে। আম্মু বলে, এতো বড় চাকরি করিস, এতো টাকা বোনাস পাস, আত্মীয় স্বজনরে দিবি না কিছু? 

আমি "এতো টাকা" বোনাসের দিকে তাকাইয়া থাকি।সবার হিসাব মেলে, আমার হিসাব মেলে না। 

মিলি বলে, দ্যাখো তো, এইটা তোমারে কেমন লাগবে? খুব মানাবে, না? আমি ওরে ধমক দিই।দিনদিন তোমার রুচি কই যাচ্ছে বলো তো? এই ক্যাটক্যাটে পাঞ্জাবী আমি কোনদিন গায়ে দিই? 

মিলি ঠোঁট ফুলায়। 

আমি দাঁতের সাথে দাঁত চাইপা ধরি। নিজের জন্য চার হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবী কেনার মতো ধনী আমি এখনও হইনি। 

৯. 
আম্মু বলে, আমার হজ্জটা এবার করাইয়া দে, বাবা। কবে বলে মরে যাই, ঠিক আছে? 

আমি কিছু বলি না। চুপ করে থাকি। আজ তিন বছর চাকরি করে আমার লোন সাড়ে তিন লাখ। সেভিংস জিরো। ঋণগ্রস্ত মানুষের উপর কি হজ্জ ফরজ হয়? 

রাতে মিলি বলে, অবনীর ভর্তির ডেট চলে আসতেসে। টাকাটা রেডি রাইখো। 

ছোটর ফোন নষ্ট। ম্যাট্রিকে প্লাস পাইলে ওরে ফোন কিনে দেওয়ার কথা। রেজাল্ট এর দিন আগাইয়া আসতে থাকে। 

মিলি বলে, এসিটা না কিনলে আর চলতেসেই না। এতো গরমে মানুষ থাকতে পারে? 

ক্রেডিট কার্ডের এই মাসের ইনস্টলমেন্টটা আমি দিইনি। আর এক মাস না দিলে বাসায় লোক আসার কথা। আমি চোখ বন্ধ করি। 

আম্মু বলে তোর বাবার মৃত্যুবার্ষীকি আগাইয়া আসতেসে। সন্তান হিসেবে তোর একটা দায়িত্ব আছে না? 

একটু পর ভেসে উঠে স্যারের মুখ, টাকা নিবেন কি নিবেন না, আপনার ব্যাপার। কালকের মধ্যে কাজ না হলে সোজা বান্দরবান। কথাটা মাথায় রাইখেন।

বাবা আইসা পেছন থেকে আমার ঘাড়ে হাত রাখে। পা পিছলাইস না বাপ। খুব সাবধানে। অনেস্টি জিনিসটা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে দিয়েছি। এইটার বরখেলাফ তুই করিস না। 

আমি বাবা, বাবা বলে ডাইকা উঠি। বলি, বাবা, আমার টিফিনের টাকাটা? আমার যে দুইটা বই কিনতে খুব ইচ্ছা করে। 

বাবা পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢোকায়। আমি হাত বাড়াইয়া বাবার থেকে টাকা নিতে যাই। পারি না। বাবা ধীরে ধীরে শূন্যে মিলাইয়া যায়। 

আমি পা পিছলে পড়ে যাই নিচে। 

আমার গায়ের উপর একে একে জমতে থাকে মায়ের হজ্ব। আত্মীয় স্বজনের ঈদ। অবনীর ইংলিশ মিডিয়াম। রবিনের সাইকেল। ছোটর মোবাইল। মিলির এসি। বসের হুমকি। ক্রেডিট কার্ডের ইন্টারেস্ট। তরফদারের ফাইল। আর বাবার সততা। 

আমি উঠতে যাই। উঠতে পারি না।

আমার বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয় । নতুন না, আজকাল নিয়মিতই হচ্ছে। আমি অতি সন্তর্পণে আমার বুক চাইপা ধরি। পৃথিবীর কাছে থেকে আমি বুকের ব্যথা লুকাইয়া রাখতে চাই। কারণ, অসুস্থতা এফোর্ড করতে পারার মতো বিলাসিতা এখন আমার সাজে না। 

ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আমি দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে ধরি। বাট সহ্য করতে পারি না। আমি চিৎকার করে উঠি। আর কিছু আমার মনে নাই। 

১০. 
জ্ঞান ফেরার পর জায়গাটা আমি চিনতে পারি না। কেমন অন্ধকার একটা ঘর। অপারেশন থিয়েটার নাকি? 

আমার গা ছমছম করতে থাকে। অন্ধকার আমি ছোটবেলা থেকেই ভয় পাই। ছোটবেলায় লাইট নিভানোর আগে দাদি আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়ে দিতো। আমার ভয় চলে যেত। 

আমি মৃদু স্বরে ডাক দিই, দাদি? দাদি? 

কোন জবাব আসে না। আসার কথাও না। মরা মানুষ কখনও ডাকের জবাব দিতে পারে?

আমি উঠার চেষ্টা করি। উঠতে পারি না। যেন পা দুটোকে আটকে ফেলা হয়েছে কোথাও। আমি হাত নাড়াতে যাই। কিন্তু আমার হাত কই? আমার মাথা? আমার নাক? আমার কান? 

আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার মুখ থেকে কোন আওয়াজ বের হয় না। শুধু কেমন ঘরঘর শব্দ করে। 

হঠাৎই দরজা খুলে যায়। 

দুইটা লোক এসে ভেতরে ঢুকে। আবছা আলোয় তাদের চেহারা ভালো করে দেখা যায় না। 

বলে, এই ঘরের এটিএম মেশিনগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরা আউট অব সার্ভিস। আজকের মধ্যে এগুলোকে ফেলে দিয়ে আসবে।নষ্ট করার মতো এতো জায়গা আমাদের নাই। 

একটু পর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। 

ঘর ঢেকে যায় গাঢ় অন্ধকারে। এবার আর আমার ভয় লাগে না। 

মানুষের অন্ধকার ভয় পাওয়া সাজে। 

মেশিনের ভয় পাওয়া সাজে না। 

#SehriTales_Day_19
#Sadiqur_Rahman_Khan 
#Ramadan_2024

Post a Comment

0 Comments