"বড় নানা"




আম্মু আমাকে রোজা ভাঙাইয়াই ছাড়বে। 

আমি জেদ ধরে বসে আছি। রোজা আমি ভাঙবো না। 

আব্বু আম্মুরে বলে, ওরে খাওয়াও। এতো বড় দিন, অসুস্থ হয়ে যাবে তো। 

আকচালিতে বসে দাদি বলে, ছালপাল মতি!! থাকুক না রে বাপু!! একদিন দেরিত খাইলে কী এমুন হয়? 

আমি তখন কঠিন চোখ মুখ করে বসে আছি। নেলসন ম্যান্ডেলা বা মহাত্মা গান্ধীও অনশন করার সময় এমন করেছিলেন কি না, সন্দেহ। 

আব্বু বিরক্ত। উনি এসব ধর্মকর্ম দেখতে পারেন না মোটেই। উনি বোঝাতে চাইতেসেন। বাট পারতেসেন না। একটু পর পর রেগে যাচ্ছেন। আর আম্মুকে বলতেসেন, ওরে খাওয়াও। বারোটা বেজে গেসে, খাওয়াও। 

আম্মু পড়েছে উভয় সংকটে। একদিকে উনি বেশ ধার্মিক মহিলা। বাচ্চাকে রোজার অভ্যাস করানোর ব্যাপারে আগ্রহ আছে। আরেকদিকে তার মাতৃসুলভ মমতা। যদি আসলেই কোন ক্ষতি হয়ে যায়? 

শেষপর্যন্ত বিচার গেল বড় নানার কাছে। তিনি বললেন , কী হইসে নানা, রোজা কেমন চলে? 

আমি আরো শক্ত মুখ করে বলি, ভালো। আমি রোজা ভাঙবো না। 

বড় নানা জিহ্বাতে কামড় মেরে বলে, ছি ছি, নানা। রোজা ভাঙার কথা তো বলাই যাবে না। 

আমার জানে পানি আসে। যাক একজন মানুষ তো অন্তত আমার পক্ষে। 

আমি বিড়বিড় করে বলি, গতবার সানি ৪ টা রোজা করেছে। সাগর করেছে ৬ টা। মিলন ৩ টা। আমি একটাও করিনি। আমি এদের চে বেশি রোজা করতে চাই। 

বড় নানা মাথা নেড়ে বললেন, অবশ্যই মিলন, সাগরদের চেয়ে তোমার রোজা বেশি হতে হবে। খান বংশের ছেলে হয়ে তুমি হেরে যাবা, তা হয় নাকি? 

আমি টগবগ করে ফুটে উঠি। 

নানা আমার মাথায় হাত রাখে। বলে, কিন্তু নানা, বাচ্চাদের আল্লাহ ভালোবাসেন। তাই বাচ্চাদের রোজা দুইটা। ইফতারও দুইটা। সাওয়াব বেশি। মিলন আর সাগরের চেয়েও বেশি। তুমি বরং দুইটা করে রোজা করো দিনে? 

আমি চমৎকৃত হই। এমনে করলে রোজা হবে? নানা বলে, অবশ্যই হবে। বারোটায় একবার খাবা। চারটায় একবার খাবা। সেহরি খাবা। তারপর সবার সাথে ইফতার করবা। এভাবে রোজাতে সাওয়াব বেশি। 

আমার মনে তখনও সন্দেহ, তাইলে বড়রা খায় না কেন? 

নানা বললেন, বড়রাও খায়। লুকাইয়া লুকাইয়া খায়। তুমিও লুকাইয়া খাবা। রমজানের সময় দেখাইয়া দেখাইয়া খাওয়ার নিয়ম নাই। 

নানার কথায় আমি দিনে একটা রোজার চিন্তা বাদ দিই। দিনে দুইটা করে রোজা রাখা শুরু করি। আব্বু খুশি হয়।হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আম্মুও। 

২. 
এরপর থেকে বড় নানা হয়ে গেলেন আমার কাছে মুশকিল আসান টাইপের। 

দুআ করি, কবুল হয় না। আমি উনার কাছে যাই। উনি আমাকে নতুন দুআ শিখান। 

জান্নাতে নাকি জাহান্নামে যাবো, সেইটা জিগাই। উনি আমারে বলেন, জান্নাতে যাবা ভাই। আমরা দুই ভাই একসাথে জান্নাতে থাকবো। 

শীতে ওজু করতে ভয় লাগে, কী করবো? সবাই বলে, করতে হবে, ছোট মানুষ, এতো শীত কিসের? নানা বলে, ছোট মানুষ, এতো ঠান্ডা পানিতে ওজু করতে পারিস? ছোটদের ওজু ছাড়াও নামাজ হয়। 

একবার কুরবানির ছাগল আনা হলো। আমি নাম রাখলাম লালু। এতো খাতির হয়ে গেল। আমি আর কুরবানি করতে দিবো না। কান্নাকাটি, চিৎকার চেচামেচি। কঠিন অবস্থা। 

নানা এসে আবার মাথায় হাত রাখেন। বলেন, লালু এখন আল্লাহর কাছে যাক। আমরাও যাবো। তখন আবার লালুর সাথে তোর দেখা হবে। 

আমি লালুর গলা ছেড়ে দিই। 

২. 
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো দুপুরে। 

বড় নানার মৃত্যুর খবর আসলো রাতে। 

নানার জানাজা পড়লাম দুপুরে। সম্ভবত ঐটাই ছিলো ঠিকঠাক কোন নামাজ শেষবারের মতো পড়া। 

ঘুন ধরার শুরুটা ছিলো স্কুল লাইফ থেকেই। শহরে চলে আসার কারণে বড় নানা ছিলো না। তাই মুশকিলের পর মুশকিল এসে জড়ো হলো, আসান আর করা গেল না। 

আরজ আলী মাতুব্বর। বর্ট্রান্ড রাসেল। হুমায়ূন আজাদ। প্রবীর ঘোষ। 

খোদা, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম। সবকিছুকেই মনে হতে লাগলো ঝাপসা।অনেক দূরের কিছু। বস্তুবাদ আর বিজ্ঞান যতটা না শিখি, তারচে বেশি শেখার ভান করি। 

ফলাফল যা হওয়ার, তাই হলো। 

কলেজে যাইয়া আমি প্রথমবারের মতো রোজা ভাঙলাম। এবার আর জোর করতে হয় নাই। নিজের গরজেই ভাঙলাম। 

তুহিন ভাই হাতে তুলে দিলেন মদের বোতল। এইটা খা। স্টেরিওটাইপ ভাঙতে হবে। ভয় ভাঙতে হবে। ধর্ম মানেই ভয়ের কারবার। একবার ভয় ভাঙতে পারলেই দেখবি, কোথাও কেউ নাই। সবকিছু শূন্য। 

আমি ঢকঢক করে গিলে ফেলি। হাত বাড়ায়ে ধর্মকে ধরতে যাই, খোদা ধরতে যাই, জান্নাত ধরতে যাই। কোথাও কেউ নাই। আসলেই তো, সবকিছু কেমন শূণ্য!! 

৩. 
নামাজ ছেড়ে দেওয়ার পর আম্মু কান্নাকাটি করলো অনেক। 

তাবলীগের বন্ধুরা নিয়ে গেল তিনদিনের চিল্লায়। হেদায়েত হওয়ার বদলে উল্টো প্রশ্ন করতে করতে বিরক্ত করে ফেললাম। হুজুর বললেন, আল্লাহ তোমার অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। 

ততদিনে আমি গর্বিত জাহান্নামি। লেখাপড়া চাঙ্গে তুলে আমরা বিজ্ঞান করি আর ধর্মের গোষ্ঠী উদ্ধার করি। ধার্মিকরা আমাদের সাথে তর্ক করতে এসে হেদায়েত দিয়ে শুরু করে, গালিগালাজ আর অভিশাপ দিয়ে শেষ করে। 

তুহিন ভাই বলে, বুঝলি সাদিক। ধর্ম জিনিসটা হলো আফিমের মতো। একবার খাইলে তুই শেষ। মানুষ থেকে তুই হয়ে যাবি জানোয়ার। খবরদার ধর্মের ফাঁদে পড়া যাবে না। 

আমি মাথা নাড়ি। আসলেই তো। গাজার ধোঁয়াতে আমি ধর্মের স্টেরিওটাইপ ভাঙি। 

বন্ধুরা হায় হায় করে। কেউ ওয়াজের সিডি দেয়। কেউ দেয় মরিস বুকাইলি। কেউ শাসায়। কেউ ভয় দেখায়। আম্মু কান্নাকাটি করে। বাট লাভ হয় না।।

রমজান থেকে রমজান আসে। লোকজন নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে। আমি হাসি। যত্তসব ধার্মিক জানোয়ারের দল। 

৪. 
বড় নানাকে আবার সামনে দেখে চমকে উঠি।

নানা কাধে হাত রাখে। বলে, কিরে ভাই, সেহরি খাবি না? সাগর আর মিলনের চে রোজা বেশি হতে হবে না? 

আমি উত্তর দিতে পারি না। আমার শরীর ঘামে ভিজে যায়। 

নানার মুখে সেই হাসি। মুশকিল আসানের হাসি। 

আমি বলি, ধর্ম মানে জানোয়ার!! 

নানা বলে, জানোয়ার মানে জানোয়ার। জানোয়ারের আবার ধর্ম আছে নাকি? 

আমার মাথা ভারী হয়ে উঠে। বড় নানা চলে যেতে থাকে। বলে, বাচ্চাদের আল্লাহ খুব ভালোবাসে ভাই। তুই এখনও বাচ্চা। তোরেও আল্লাহ ভালোবাসে। 

আমি পালাইতে চাই। পারি না। 

নানা আবার বলে, এই যে আমি আছি এখানে, লালু আছে, তোর দাদি আছে। তুই আসবি না? আমাদের না দুই ভাইয়ের একসাথে জান্নাতে থাকার কথা? খান বংশের ছেলে তুই। এভাবে হেরে গেলে চলবে?

নানা শূন্যে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। রেখে যায় আতরের গন্ধ!!

প্রবল ঝাকুনিতে আমার ঘুম ভাঙে। 

আমি থরথর করে কাঁপতে শুরু করি। 

এবং কোথাকার কোন এক অমোঘ টানে, আমি উঠে নামাজে দাঁড়াইয়া যাই। সম্ভবত নানার জানাজার দুই বছর পর।

 আমার কানে বাজে নানার সেই কন্ঠ, আল্লাহ বাচ্চাদের ভালোবাসে ভাই!! তুই তো আরো বড় বাচ্চা, অবুঝ। তোরে ভালো না বেসে পারে!!

আমি হুহু করে কেঁদে উঠি। 

বহুদিন পর কেউ আমারে ভালোবাসা কথাটা বললো। বহুদিন পর। 

৫. 
ঈদের দিন নামাজ শেষে আমি বড় নানার কবরে গিয়েছিলাম। 

কবর আমি ভয় পাই। তবে বড় নানার কবররে কেন যেন আমার ভয় লাগে না। বরং এতো আপন আপন লাগে!! 

তুহিন ভাই বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। আমি বুঝিনি। লজিক দিয়ে লজিক বিট করা যায়। বাট লজিক দিয়ে কি ভালোবাসা বিট করা যায়? যায় না।

ধর্ম কি মানুষকে জানোয়ার বানায়? জানি না আমি। শুধু জানি, আমার বড় নানা আর দাদি ছিলেন আমার দেখা পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ। ধর্ম বিশ্বাস করে তারা যদি অমন মানুষ হতে পারি, তবে তাই সই। 

তুহিন ভাই মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ভুল করলি সাদিক। আমি শেষ সিগারেটটাও পদ্মায় ফেলে দিয়ে চলে আসলাম। 

সেই পদ্মাতেই তুহিন ভাই আত্মহুতি দিলেন মাস খানেক পর। 

আহারে!! 

যেই যুক্তি, যেই এনলাইটেপমেন্ট মানুষরে মেরে ফেলে, সেই লজিক কখনও মানুষের না হোক!! 

আমি চোখ বন্ধ করি। 

আবারও আমার সামনে ভেসে উঠেন বড় নানা। জিগায়, কী নানা, রোজা কেমন চলছে? এইবার আমিও হাসি। সাগর আর মিলনকে জিততে দেওয়া যাবে না নানা। 

আমি চোখ খুলি। 

এবার আমার সামনে ভাসে তুহিন ভাইয়ের নিথর দেহ। বড় বড় চুল। ফুলে যাওয়া মুখ।চোখ। কালচে হয়ে আসা শরীর।।মাদকের দমকে ভেঙে আসা শরীর। 

আচ্ছা, তুহিন ভাই মরলো কেন? 

লজিক ছিলো। যুক্তি ছিলো। জাহান্নামের ভয় ছিলো। তর্ক ছিলো। অভিশাপ ছিলো। অভিযোগও ছিলো। মরিস বুকাইলির বাইবেল, কোরান ও বিজ্ঞানও ছিলো। 

তবে তুহিন ভাই মরে গেল যে? 

আমি চোখ বন্ধ করি।বড় নানা এসে বলে, আল্লাহ বাচ্চাদের বড় ভালোবাসে নানা ভাই। 

আমি উত্তর পেয়ে যাই। 

তুহিন ভাইয়ের কাছে সব ছিলো।শুধু একটা বড় নানা ছিলো না। 

ঐ মমতাটুকু ছিলো না। 

তুহিন ভাইরেও নিশ্চয়ই অনেকে অনেক কথা বলেছে। 

কেউ লজিক, কেউ ধর্ম, কেউ জান্নাত, কেউ জাহান্নাম। বাট তারে কেউ ভালোবাসার কথাটা বলে নাই। কেউ বলে নাই, তোমারেও আল্লাহ অনেক ভালোবাসে, নানাভাই!! 

রমজান আসলেই তাই আমার নিজের কথা মনে পড়ে। বড় নানার কথা মনে পড়ে।

আর মনে পড়ে তুহিন ভাইয়ের ঐ লাশটার কথা!! 

এই পৃথিবীতে খোদা কত কত সাদিক পাঠায়।

তুহিন পাঠায়। 

লজিক পাঠায়, জ্ঞানীও পাঠায়। 

অথচ আমার বড় নানার মতো, একটু ভালোবাসার কথা বলা মানুষ খোদা যে এই পৃথিবীতে এতো কম কেন পাঠায়, কে জানে!!

#SehriTales_Day_01 
#Sadiqur_Rahman_Khan 
#Ramadan_2024

Post a Comment

0 Comments