শিক্ষিত বেকার

 ‘শিক্ষিত বেকার’                                              তারিখঃ ১২/০৯/২০


আমি ‘রুদ্র’ একজন শিক্ষিত বেকার, শিক্ষিত বেকারত্বের ট্যাগটা এইজন্য লাগাচ্ছি কেননা অন্যান্য গ্রাজুয়েট বেকারদের মতো আমিও পড়াশোনা শেষ করেও চাকরিটা জোগাড় করতে পারিনি। এখন পর্যন্ত প্রায় ‘শ’ খানেক জায়গায় টিভি ড্রপ ও ইন্টারভিউ দিয়েছি, কিন্তু মাতৃগর্ভ থেকে নিয়ে আসা চাকুরীর এক্সপেরিয়েন্সটা নেই বলে প্রত্যেকবারই হতাশার মুখ দেখেছি। সে যাই হোক এখন এসব নেগেটিভ কথাবার্তা না বলি, আজকে এক কোম্পানি থেকে ইন্টারভিউ কল এসেছে, আজকের ইন্টারভিউতে টিকে গেলেই হলো। ইন্টারভিউ টাইম সকাল ১১
টা, বাসা থেকে প্রায় ২০-২৫ মিনিটের পথ, যেহেতু বেকার হিসেবে মানিব্যাগেরও বেহাল দশা থাকে, সুতরাং বাসা থেকে অর্ধেক রাস্তা হেঁটে ও বাকিটা পথ রিকশায় যেতে হবে এতে রিক্সা ভাড়া ৫০ টাকা থেকে ২৫ টাকায় নেমে আসবে, এখন যেহেতু পৌনে দশটা বাজে তাই এখনই বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করতে হবে, নিউ মার্কেট পৌঁছে সেখান থেকে রিক্সায় করে সোজা দুই নম্বর সেক্টর উপশহর। অফিসটা মেইন রোডের পাশেই হওয়ায় খুঁজে পেতে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি, অফিসের ভেতর ঢুকে ২ ধাপ এগোতেই ছখে পড়লো প্রায় দুই-শত বেকার যুবকের মেলা। সেই মেলার ভিড়ে একটি ফাঁকা স্থানের অস্তিত্ব বের করে সেখানে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করলাম। আমার একটি স্বভাব আছে যেখানেই ইন্টারভিউতে যাই না কেনো, ভিড়ের মাঝে চোখ বুলিয়ে নেই পরিচিত কাউকে পাওয়া যায় কিনা সেই সন্ধানে। আজও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, সেই ভিড়ের মাঝেই আজকে খুঁজে পেলাম একটি চিরচনা মুখ, আমার স্কুলফ্রেন্ড ‘রিফাত’, প্রায় চার বছর পর আজকে তার মুখ দেখলাম। অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না, ছুটে গেলাম তার কাছে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে কেমন আছি? খারাপ/ভালো কোনো কথা শুরু হওয়ার আগেই বলে উঠলো,
- ইন্টারভিউ দিতে নাকি? এখনো চাকরি পাসনি?
- নারে বন্ধু, পরিচিত কাউকে তো থাকাই লাগে, আর তা না থাকলে তো মামা-চাচার লবিং লাগবেই। আমাদের মত নন এক্সপেরিয়েন্সদেরকে কে গুরুত্ব দেয় বল? যাই হোক, তুইও কি এখানে ইন্টারভিউ দিতে?
- আরে নাহ, আমি এই কোম্পানির রাজশাহী ডিপোতে এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে আছি।
- তাই নাকি রে, তাহলে তো ভালোই হলো, আমার জন্য একটু দেখ নারে ভাই, একটা চাকরির খুব...

আমার কথা শেষ না হতেই আমাকে থামিয়ে সে বলে উঠলো,
- দেখ ভাই, নিজের যোগ্যতায় চাকরি খোঁজ, আমি এসব পারবোনা।
বিশ্বাস করেন, তার কাছ থেকে এই ব্যবহার পাবো সেইটা কোনোদিন আশা করিনি আমি। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখ মোছা ছাড়া আর কোন উপায় আমি খুঁজে পাইনি। কিছুক্ষণ পর এক্সাম শুরু হয়,প্রথমে রিটেন হবে তারপর ভাইবা। কয়েকজনের পর ভাইবাতে আমার সিরিয়ালটা আসে। আমার সিভি চেক করে দু-একটি প্রশ্নের পর এক্সামিনার বলে উঠলেন, আসলে আপনার তো পূর্বের চাকরির কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই, আমরা এক্সপেরিয়েন্সড এমপ্লয় খুজতেসি, যাইহোক আপনার সিভিটা থাকলো,পরবর্তীতে প্রয়োজনে আপনার সাথে আমরা যোগাযোগ করবো। উনার মুখে শেষ বাক্যটি শুনে বুঝতে বাকি রইলো না যে এই চাকরিও আর হলো না। অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটা ধরলাম বাসার উদ্দেশ্যে, আসার সময় যেভাবে অর্ধেক রাস্তা হেটে, তারপর রিক্সা নিয়েছিলাম যাওয়ার সময়ও তাই করতে হবে, কেনোনা পকেটে আছে তো সেই বেঁচে যাওয়া বাকি ২৫ টাকা। নগর ভবনের কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে কে যেনো নাম ধরে ডাক দিলো,পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি রফিক আঙ্কেল।উনি বাবার বন্ধু এবং আমাদের প্রতিবেশী। উনার কাছে গিয়ে সালাম দিতেই বলে উঠলেন,
- তো বাবা কোথা থেকে এই সময়?
- একটা চাকরি ইন্টারভিউ ছিলো আঙ্কেল।
- জব ইন্টারভিউ? এখনো চাকরি পাওনি।(উনার এই প্রশ্নের কোনো মানে নেই, কেননা আমার ফ্যামিলির সুখ-দুঃখের সকল খবরই উনার জানা)
- নাহ আঙ্কেল, এখনো হয়নি কোথাও।
- আমার ছেলের কথা শুনছো? সে অমুক ব্যাংকের ম্যানেজার পদে গত মাসে পদোন্নতি পেলো।
- জী আঙ্কেল শুনলাম। (এতক্ষণে উনার আমাকে পেছন থেকে ডাকার মানে বুঝলাম, যাইহোক, উনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন বড় কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে লবিং এর মাধ্যমে ছেলেকে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন,পদোন্নতিটাও উনারই নিয়ে দেয়া।)
- বাবা, পড়াশোনাটা যদি একটু ভালোভাবে করতে তাহলে এতোদিনে একটা ভালো চাকরি করতা।(অথচ উনার ছেলে কলেজে আমার নকল করে পাশ করেছে, ভার্সিটি শেষ করেছে তাও আবার নামমাত্র ডিগ্রি নিয়ে।)
- জি আঙ্কেল, দোয়া রাখবেন বলেই সোজা হাটা ধরলাম।
এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের কথায় মনে হয় যেন বুকের ভেতরটা ছুরি দিয়ে চিড়ে ফেলবে, একটি ছোট বাচ্চার কান্নার যে দাম আছে, একজন বেকারের চোখের পানির সেই দামটা নেই। একজন বেকারের যা করার থাকে তা হচ্ছে ভালো দিনের আশায় বসে থাকা, হয়তো একদিন সুখের মুখ দেখাবেন সৃষ্টিকর্তা।




Post a Comment

0 Comments