একদম সোজাসাপ্টা যদি বলি—বই আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে। বই আমাদের ভিতরে সেন্স তৈরী করে। বিচার ও বিবেচনা তৈরী করে। বোধ ও উপলব্ধিকে গভীর করে। দৃষ্টি ও চিন্তাকে সূক্ষ্ম ও অতলস্পর্শী করে তোলে। যারা পড়ে আর যারা পড়ে না, তাদের আলাপের ধরণই হয় দুই রকমের। যারা বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় পাঠ গ্রহণ করেনি, তাদের সাথে আপনি অন্য কোন বিশেষ প্রণোদনা ছাড়া নিউট্রাল জায়গা থেকে বন্ধুসুলভ যে গল্প বা আড্ডা, সেটা চালিয়ে যেতে পারবেন না। ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। কারো হয়তো মেধা আছে, সেটা দিয়ে সে আড্ডা বা তর্কে অনেক দূর ম্যাচ করে ফেলতে পারবে, কিন্তু এর জন্য তাকে প্রচুর বকোয়াজ করতে হয় এবং দিন শেষে তার পাঠহীনতা ধরা পড়ে। বিরক্তি, অনাগ্রহ ও ক্লান্তি তৈরী করে। কথাটা একটু রুঢ়; কিন্তু সম্ভবত মিথ্যা নয়।
নিরপেক্ষ জায়গাটা একটু পরিস্কার করি। ধরুন, ফ্যামিলি মেম্বার। এটা হলো রক্তের বাধন, আত্মার টান, ভালোবাসা। এর পথে পাঠহীনতা বা অন্য কিছুই বাধা হয়ে উঠতে পারে না। অথবা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। যেমন, স্বামী স্ত্রী। অথবা দীনি বা ইসলাহি সম্পর্ক। এমন অনেক প্রণোদনা থাকতে পারে। কিন্তু এমন শক্তিশালী কোন প্রণোদনা না থাকলে নিছক সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব যে ব্যাপারটা, এটা ঘটে মূলত চিন্তা ও আলাপ আলোচনার ইন্টারেস্ট থেকে। এবং এখানে বই একটা সিম্বল আসলে। মূল হলো জ্ঞান অর্জন। জানাশোনা। এটা বই পড়ে হতে পারে, উস্তাদ বা জ্ঞানী কারো দরসে বসে হতে পারে, হালে ভালো আলোচকদের অডিও ভিডিও শুনে হতে পারে, অন্তর্জালের বিভিন্ন আর্টিকেল পড়েও হতে পারে।
তবে এটা সত্য, শুধু পাঠ বা শ্রবণ সেন্স তৈরী করে না। সেন্স তৈরী হয় যদি পঠিত বা শ্রুত বিষয়টিকে আমি ধারণ করতে পারি। ধারণ করা মানে সেটি যদি আমার চিন্তা ও আবেগকে উস্কে দিতে পারে এবং আমি এর সাথে এগোতে পারি—একমত হয়ে বা দ্বিমত করে।
বই পড়া মাত্রই ভালো বা উৎসাহমূলক কিছু নয়। দেখার বিষয় হলো আমার প্রয়োজনীয় বইটা আমি পড়ছি কি না। পরিস্থিতি, বাস্তবতা, পেশা ও স্তরভেদে একেকজনের পাঠ প্রয়োজন একেক রকম। এটা না বুঝে কেউ যদি ‘ধুমায়া’ পড়তে থাকে, সে নানাভাবে উচ্ছন্নে যাবে। অকালপক্কতা, বক্রতা, ‘অতিপাণ্ডিত্য’সহ আক্রান্ত হবে নানান রোগে। সেই সাথে ‘মাত্রাতিরিক্ত’ পাঠের নেশা ও বাছবিচারহীন অপ্রয়োজনীয় পাঠ তাকে নির্জীব ও অপ্রৈথিবীক করে ফেলবে। এমন ডাম্ব লোকজন পরে আর কোন কাজের হয় না। পলায়নপর মানসিকতার অধিকারী হয়।
পাঠের পরিমাণ সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। পেশা ও প্রয়োজনের কারণে কারো কারো জন্য দৈনিক ‘৫০০’ পৃষ্ঠা কেন, হাজার পৃষ্ঠা পড়ার প্রয়োজনও হতে পারে। এবং এটা গুনে গুনে ঠিক প্রতিদিনই যে হতে হবে তা কিন্তু নয়। ফলে, ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ার যে কথাটি নিয়ে ইদানিং রসিকতা করা হচ্ছে, রসিকতার কিছু নাই। এটা সবার জন্য না, সবসময়ের জন্যও না। প্রতিটি কথার একটা উপযুক্ত জায়গা আছে। যদি এমন উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায়, কথাটাসে সে জায়গায় সেট করেই বুঝতে হবে।
পাঠের ক্ষুদ্র একটা পরিমাণ থাকে বিনোদনমূলক। খেয়াল রাখতে হবে, বিনোদন সারাদিন করবার জিনিস না। বাচ্চাদের জন্য খেলাধুলাটা আমরা যেমন আসর থেকে মাগরিব—বিকালের এই সংক্ষিপ্ত একটা সময়ে কামনা করি, তেমনি বিনোদনমূলক পাঠও স্বল্প ও পরিমিত হওয়া উচিত। আপনি দিনের পর শুধু গল্প উপন্যাস পড়ে যাবেন, এটা কোন কাজের কথা না।
‘আমি পড়িটরি না’ বলে কেউ কেউ গর্বটর্ব করতে চান। এটা বোকামি। মূলত নিজের না পড়া জনিত গ্লানিকে বিচারসম্মত করে একটা মিথ্যা আত্মতুষ্টিতে রূপান্তরের ব্যর্থ চেষ্টামাত্র।
মানুষের ভিতরে জ্ঞান পিপাসা কাজ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সব পিপাসায় সমর্থন দিয়ে বসাটা বোকামি। আমাদের জীবনে সময় খুব কম। প্রত্যেককে তার জীবন বাস্তবতা ও প্রয়োজন সামনে রেখে তার প্রয়োজনীয় পাঠকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। এমন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোন বিশ্লেষণ বা কোন ডকুমেন্টারি দেখে আপনার ভিতরে এটা নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ কাজ করতে পারে। কিন্তু এভাবে ছুটতে থাকলে আপনি দিনের পর দিন বিক্ষপ্ত হয়েই থাকবেন, এবং আধাখেচড়াভাবে নানান কিছু জানবেন, কিন্তু দিনশেষে কিছুই হতে পারবেন না।
একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে আপনার একটা কমন বিশ্বদৃষ্টি থাকা দরকার। সেটা অবশ্যই। কিন্তু তারও একটা লিমিট আছে। নিজের সময়কে হিসেব করে কাজে লাগান। নিজের বিষয়ে ফোকাস করুন। আজাইরা সময় নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন পাঠের ক্ষেত্রে ‘কী পড়ব, কেন পড়ব’ এই প্রশ্ন দুটো খুবই জরুরী। আ. আ. সায়ীদের ‘আলোকিত মানুষ চাই’ প্রোগ্রামে এমন কোন বাছ বিচার নাই। ফলে, এটা ফালতু জিনিস। ডাম্ব লোকজন তৈরীর কারখানা ছাড়া কিছু নয়।
যারা লেখালেখি করেন, শব্দ বাক্য ভালো সাজাতে পারেন, তারা যদি নিয়মিত দরকারি পাঠটা না করেন, তাহলে তার পরিণতিটা শেষ পর্যন্ত আমার মতো হবে। মানুষ আপনাকে পড়বে না। কারণ, কিছু দিনের ভিতর ধরা পড়বে আপনার কথায় সারবত্তা আসলে কিছু নাই। শব্দের বাগাড়ম্বর শুধু।
~ সাবের চৌধুরী
[প্রকাশিতব্য 'কোথাও নিঝুম হয়েছে কেউ' বই থেকে...]
0 Comments