‘আলোর পথ’ তারিখঃ ১৩/০২/২৪
অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্য রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। রিকশা খুঁজতে খুঁজতে
হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার অপর পাশে দাঁড়ানো পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত এক যুবকের প্রতি।
প্রথমদিকে একটু চিনতে সমস্যা হলেও পরে চিনতে পারলাম ও আমার স্কুলের ক্লাসমেট
রাহাত। স্কুল জীবনে ও যে স্বভাবের ছিলো তার জন্য প্রথম প্রথম দাঁড়ি টুপিতে তাকে
দেখে অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। রাহাত স্কুলে রেগুলার ছিলো না,একদিন আসলে
দুইদিন তার খবর নেই। তবে যেদিন আসতো সেইদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার মতো কাণ্ড করে
সে বাসায় যেতো। একদিনের ঘটনা বলি তাহলে ওকে চিনতে আপনাদের সুবিধা হবে। ক্লাসরুমে
ওর নির্ধারিত একটি বেঞ্চ ছিলো,সেই বেঞ্চ ছাড়া অন্য কোনো বেঞ্চে সে বসে না। এক ছেলে
খুলনার কোনো এক স্কুল থেকে বদলি হয়ে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়। ছেলেটি প্রথম দিনে
অন্য সিটে বসলেও যেদিন রাহাত স্কুলে আসলো সেদিন তার সেই বেঞ্চে বসে পড়ে। অন্য
কাওকে তার বেঞ্চে বসে থাকতে দেখে সে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে,ক্লাস
রুমের বাইরে থাকা আম গাছের ডাল ভেঙ্গে এনে ছেলেটিকে যে কেলানি দিয়েছিলো সেদিন,যে তারপর
থেকে ছেলেটিকে আর স্কুলের ত্রি সীমানার মধ্যে দেখা যায়নি। আরেকদিনের ঘটনা বলি, শহিদুল
ইসলাম নামে আমাদের একজন গণিত শিক্ষক ছিলেন। একদিন কোনো এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্য
স্কুলের এক ছেলেকে রাহাত মারে, ঐ ছেলে আবার স্যারের নিকটাত্মীয়। স্যার এই ঘটনা শুনে
বেত দিয়ে ক্লাসে সবার সামনে তাকে খুব মারেন। সবার সামনে এইভাবে নিজেকে অপমানিত হতে
দেখে রাহাত তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি,
যার কারণে স্কুল থেকে স্যার বাসায়
ফেরার পথে রাহাত তার মাথা ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে মেরে ফাটিয়ে দেয়। এই কাণ্ড
ঘটানোর জন্য যদিও তাকে প্রায় ১৫ দিনের মতো জেলে কাটাতে হয়েছিলো,তবুও এটি
তার জন্য নতুন কিছুই না। একের পর এক ঘটনা এইভাবে বলা শুরু করলে তার আত্মজীবনী লিখে
শেষ করা যাবেনা। তাই চলুন মূল ঘটনায় ফেরা যাক।
- নাহ, তার এতোটা
পরিবর্তনের কারণটা না জানলে আমার কৌতুহল মিটবে না। তার কাছে যেতেই ঘারে একটা চাপর
মেরে বলে উঠলো,
- কিরে ব্যাটা, কেমন আছিস?
-এইতো, আলহামদুলিল্লাহ্।
তোর যে দেখাই পাওয়া যায়না, কেমন আছিস?
থাকিস কোথায় এখন?
- আলহামদুলিল্লাহ্, বেইলি
রোডের কাছে আমার বাসা। তো কি করছিস এখন?
এইদিকে কি কাজে?
- এইতো সামনে একটা আইটি ফার্ম
আছে সেখানে আছি রে, ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে, আর তুই?
- জানিসই তো, ছোট থেকেই
আমার পড়াশোনার প্রতি অনীহা ছিলো, তাই এইচ.এস.সি পরীক্ষাটা কোনোমতে দিয়ে যখন দেখলাম ফেল
তারপর আর পড়াশোনা করিনি। পরের চাকরি করা আমাকে দিয়ে হবেনা, তাই সামনের
মজিদ মার্কেটে জায়নামাজ, আতরের দোকান দিয়েছি। সেইটা দিয়ে চলছে আলহামদুলিল্লাহ।
- মা শা আল্লাহ্, শুনে খুব
ভালো লাগলো। তুই কিছু মনে না করলে তোকে একটা প্রশ্ন করবো?
- হ্যাঁ, বলে ফেল, মাইন্ড
করার আবার কি আছে?
- তোর স্বভাব চরিত্রে হঠাৎ
এতোটা পরিবর্তন দেখে আমার আসলে বিশ্বাস হচ্ছে না, ঘটনাটা একটু খুলে বলবি?
- বলছি, আগে চল
একটু সামনে যাই, ভালো একটা চায়ের দোকান আছে, চা খেতে
খেতে কথা বলি।
- আচ্ছা চল।
চায়ের দোকানে বসে ধোঁয়া ওঠা
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম,
- তাহলে বল এইবার।
- শোন, শান্তর কথা
মনে আছে তোর?
- উমম, শান্ত!
আমাদের স্কুলের শান্ত? যেই আমাদের স্কুলে টিফিন টাইমে খেলার বদলে নামাজে দৌড়
দিতো?
হ্যাঁ, ঐ শান্তর
কথাই বলছি। একদিন ওর এলাকায় গেছিলাম দোকানগুলো থেকে চাঁদা তুলতে। এক দোকানির
সারাদিন ব্যাবসা নাই বলে কালকে চাঁদা দিবে বলে আমাকে। আমি আজকেই দিতে হবে বললেও সে
দিতে চায়না। আমার রাগ যখন প্রচণ্ড বেড়ে যায় তখন দোকান থেকে বের করে ঐ মাঝবয়সী
বয়স্ক মানুষটিকে মাটিতে ফেলে কয়েকটা লাথি আর কিল-ঘুষি দেই।সেই এলাকার সবাই আমাকে
চিনে তাই ভয়ে কেও এগিয়ে আসেনি। ঐ ঘটনাটা শান্ত রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে
ফেলে, আমাকে ওইখান থেকে টেনে সরিয়ে ফেলে, লোকটিকে এক দোকানে বসিয়ে
দেয়। তারপর আমার কাছে এসে বলে, দোস্ত আলোর পথে আয়, অন্ধকার জগত থেকে বের হয়ে
আয়। কতোদিন এই চাঁদাবাজি, মারামারি এসব নিয়ে পড়ে থাকবি? তোর বাবারও
এখন বয়স হয়েছে, মানুষটা এখন ঠিকমতো সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেনা, অসুখ বিসুখ
তাকে জেঁকে ধরেছে, সেদিন জলিল কাকার কাছে তোকে নিয়ে কতো দুঃখের কথা বলছিলো
সেলিম ভাইয়ের দোকানে বসে। তোকে নিয়ে তার কতো স্বপ্ন ছিলো,নিজে
পড়াশোনা করেন নি,তাও তোকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন তার ছেলে
তার মুখ উজ্জ্বল করবে কিন্তু তুই...?
প্রকৃত মুমিন বান্দা হো বন্ধু, ট্যাগ
লাগানো মুসলিম হোস না, যে বান্দা অন্যের হক মেরে খায়, যার হাতে
আরেক ভাই নিরাপদ না।
তার কথাগুলো শুনে কেনো জানি
অন্য রকম অনুভূতি হলো সেদিন, এর আগেও আমাকে ভালো হতে অনেকে নসিহত করলেও তাদের
কথাগুলো আমার মনে এইভাবে নাড়া দেয়নি। তার কাছ থেকে বাসায় গিয়ে রাতে সারারাত দুই
চোখের পাতা এক করতে পারিনি। জেগে থাকতে থাকতে ফজরের আজান কানে ভেসে আসলো। এতোদিন
নেশা করে বাসায় এসে রাত তিনটায় ঘুমিয়ে দুপুরে ঘুম থেকে উঠতাম। কিন্তু সেদিন
কেনোজানি, আমার জামায়াতে ফজরের নামাজ পড়তে ইচ্ছে হলো। বিছানা ছেড়ে উঠে অজু করে
মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম। নামাজের প্রতি রাকআতে আমার মনে হচ্ছিলো, ভেতর থেকে
প্রশান্তির মাত্রাটা এক এক করে বাড়ছে। তারপর থেকেই আলহামদুলিল্লাহ্ আস্তে আস্তে
আমার এই আলোর পথে ফিরে আসা।
- মা শা আল্লাহ্ বন্ধু, এই জন্যই
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: "এটা আল্লাহ্র পথনির্দেশ, তিনি তা
দ্বারা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন
হেদায়াতকারী নেই।"[সূরা যুমার,
৩৯:২৩]
তিনি আরও বলেন: "আল্লাহ্
যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।"[সূরা আনআম, ৬:৩৯]
তিনি আরও বলেন: "আল্লাহ্
যাকে পথ দেখান সে-ই পথ পায় এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তারাই
ক্ষতিগ্রস্ত।"[সূরা আল-আরাফ, ৭:১৭৮]
বন্ধু আজ উঠি রে তাহলে সামনের
দিন তোর দোকান দেখতে আসবো ইন শা আল্লাহ্।
- ইন শা আল্লাহ্ বন্ধু, আসিস কিন্তু।
রিকশায় বসে বসে ভাবছি, কতোটা
সৌভাগ্যবান সে যে সময় মতো হেদায়েত পেলো,
আর কতোটা দুর্ভাগ্যবান সে যে, আজও এই
হেদায়েত নামক জিনিসটা পায়নি।
0 Comments