কা’বার গিলাফ!

কা’বার কথা মনে পড়লেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে কালো গিলাফ। কিন্তু, কাবার গিলাফ কি সবসময় কালো ছিলো? কমেন্টের ছবিতে যে গিলাফ দেখতে পাচ্ছেন, অনেকটা এরকমই ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কা’বার গিলাফ! 

ইয়েমেনের রাজা ছিলেন তুব্বা আবু কারিব। ৩৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইয়েমেনের শাসক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের ১৩৮ বছর পূর্বে, ৪০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনিই প্রথম কাবার গিলাফ লাগান। 

যেনতেন কাপড় দিয়ে এই গিলাফ দেয়া যেতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কাপড় আমদানি করা লাগতো, বেশ দামি কাপড়। মক্কার লোকজনের এমন সামর্থ্য ছিলো না যে প্রতিবছর কাবার গিলাফ পরিবর্তন করবে। 

আবু রাবিয়া আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ছিলেন কুরাইশের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। আবু রাবিয়া প্রস্তাব দেন তিনি একবছর কাবার গিলাফ পরিবর্তন করবেন, পরের বছর মক্কার সবাই মিলে। তার প্রস্তাবে রাজি হলে দেখা যায় এক বছর তার অর্থায়নে, পরের বছর পুরো মক্কাবাসীর অর্থায়নে কাবার গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। 

আবু রাবিয়া আব্দুল্লাহ ইবনে আমর প্রথম ব্যক্তি যিনি কাবার গিলাফে সিল্কের কাপড় ব্যবহার করেছিলেন। 

৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয় হয়। তখনো কাবার গিলাফে পৌত্তলিকদের দেয়া কাপড় ছিলো। কিন্তু, এই বছর দুর্ঘটনাবশত একজন নারী কাবায় ধূপ জ্বালাতে গিয়ে গিলাফ পুড়িয়ে ফেলেন। ফলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আবার কাবার গিলাফ পরিবর্তন করতে হয়। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদা-লাল রঙের ইয়েমেনী ডোরাকাটা কাপড় কাবার গিলাফের জন্য ব্যবহার করেন। 

অর্থাৎ, আমাদের সময় কাবার যে কালো গিলাফ দেখি, এরকম গিলাফ তখন ছিলো না। যাস্ট ইমাজিন, টাইম ট্র্যাভেল করে ঐসময়ের জায়গাগুলো যদি আমরা দেখতে পারতাম অথবা হঠাৎ যদি সীরাহ মিউজিয়ামে গিয়ে রাসূলুল্লাহর যুগের কাবা দেখতে পাই, আমাদের মধ্যে ৯৯% মানুষের প্রশ্ন জাগবে- কাবার গিলাফ লাল-সাদা কেনো? কালো গিলাফ কোথায়? 

মাঝখানের আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী ছিলেন নুতাইলা বিনতে জানাব। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর মা। 

ওহ, এখানে আরেকটি কনফিউশান দূর করি। 

আব্দুল মুত্তালিব মোট ৬টি বিয়ে করেন। তাঁর ৬ স্ত্রীর মধ্যে একজন ছিলেন ফাতিমা বিনতে আমর; যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর আপন দাদি। আর নুতাইলার ছেলে ছিলেন আব্বাস। অর্থাৎ, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের চাচা হলেন দাদার সূত্রে, দাদির সূত্রে না। 

আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হারিয়ে যান। তখন নুতাইলা মানত করেন, ছেলেকে ফেরত পেলে তিনি নিজ অর্থায়নে কাবার গিলাফ পরিবর্তন করবেন। 

আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ফেরত পাবার পর নুতাইলা বিনতে জানাব তার মানত পূরণ করেন। যার ফলে, তিনিই ইতিহাসে প্রথম নারী যিনি এককভাবে কাবার গিলাফ পরিবর্তন-অর্থায়ন করেন।

খলিফা আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম কাবার গিলাফ পরিবর্তন করে সাদা এবং সোনালী রঙের মিশরীয় কাপড় ব্যবহার করেন। 

উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথম দুটি আবরণ একসাথে ব্যবহার করেন যাতে এটি সহজে সরানো না যায়।

মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগের বছরে ২ বার কাবার গিলাফ পরিবর্তন করা হতো। একবার আশুররার দিন, আরেকবার ঈদুল ফিতরের দিন। 

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় শাসন করেন। দ্বিতীয় ফিতনার সময় তিনি ছিলেন মক্কাবাসীর কাছে খলিফা, দামেস্কে একইসময় খলিফা ছিলো ইয়াযিদ। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ৬৪ হিজরিতে কাবার গিলাফ সাদার পরিবর্তে লাল রঙের ব্যবহার করেন। 

২০০ হিজরিতে মক্কার শাসক কাবাকে দুটি পাতলা রেশমি কাপড় দিয়ে আবৃত করেন- একটি হলুদ এবং অন্যটি সাদা।

২০৬ হিজরিতে খলিফা আল-মামুন তিনটি ভিন্ন রঙে বছরে ৩ বার কাবার গিলাফ পরিবর্তন করতেন। তারবিয়ার দিন লাল, রজব মাসের শুরুতে পাতলা সাদা, রমজানের ২৭ তারিখে সাদা রেশমি। 

৪৬৫ হিজরিতে সেলজুক সুলতান আস-সালাজিকাহর সময় কাবার গিলাফের রঙ ছিলো হলুদ। 

৬১৪ সালে আব্বাসি খলিফা আল-নাসির কাবার গিলাফ সবুজ রঙের করেন। 

এর ৮ বছর পর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাবার গিলাফ কালো রঙের করেন, মাঝখান সাজান সোনালী নকশা দিয়ে। কালো রঙ ছিলো আব্বাসিদের নিদর্শন, আব্বাসিদের প্রতীক। 

খুব সম্ভবত এটাই ছিলো কাবার ইতিহাসে প্রথম কালো গিলাফ। 

এরপর কেটে গেছে প্রায় ৮১৪ বছর। এখন আমরা যে কাবার গিলাফের কালো রঙ এবং সোনালী নকশা দেখি, এটার প্রচলন হয় আব্বাসি খলিফা আল-নাসিরের সময় থেকে। 

মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজার ওপরের সবুজ গম্বুজ যেমন আজ থেকে ২০০ বছর আগে সবুজ ছিলো না, তেমনি কাবার গিলাফও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কালো-সোনালী ছিলো না। কখনো ছিলো সাদা, কখনো সাদা-লাল, হলুদ, সবুজ। 

সীরাতের এই ধরনের স্টাডির নাম দিয়েছি Spatial Seerah। 

এই ধরনের সীরাত চর্চার একটা মজা আছে। 

যখন কল্পনা করতাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয় করছেন, কাবাঘরে তাওয়াফ করছেন, তখন ভেসে ওঠতো কালো গিলাফ। 

কিন্তু, যখন জানতে পারবো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কালো গিলাফ ছিলোই না, তখন কল্পনা একটু ভিন্ন হবে। লাল-সাদা ডোরাকাটা গিলাফ কেন্দ্র করে সাহাবীগণ তাওয়াফ করছেন। ইতিহাসের ঐ সময়টি যতো পারা যায় একুরেট চিন্তা করা যাবে এই ধরনের সীরাহ চর্চার ফলে। 

মূল ইভেন্টে তেমন একটা পার্থক্য হবে না। যারা কল্পনা করতে চান, কল্পজগতে চলে যেতে চান ১৪০০ বছর আগে, তারা অনুভব করতে পারবেন কেমন ছিলো তখন।

✍️ আরিফুল ইসলাম


Post a Comment

0 Comments