ধরুন আপনার লেখালিখির কাজ শেষ , এবার বই ছাপাবেন। এইরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনার কী কী জিনিস জানা দরকার ?
আমি বলছি তাদের কথা যাঁরা প্রথমবারের মতো বই বের করছেন । কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখলে দেখবেন আখেরে লাভ, কারণ একবার ছাপা হয়ে যাওয়া মানে ভুল শোধরানোর আর কোনো জায়গা নেই।
আর এই বেসিক জিনিসগুলো জানা থাকলে আপনার প্রকাশক ঠিকঠাক কাজ করছেন কিনা , সেটাও খেয়াল রাখতে পারবেন।
১. বই এর প্রচ্ছদ , লেখক পরিচিতি, ভূমিকা , সূচিপত্র, পাতার কোয়ালিটি আর প্রিন্ট কোয়ালিটি নিয়ে কোনো আপস করবেন না , অন্তত আপনার প্রথম বই এর ক্ষেত্রে। বিখ্যাত লেখক/লেখিকাকে মানুষ চেনে ,ওনাদের বই এর এইসব জিনিস একটু এদিক ওদিক হলেও মানুষ অ্যাডজাস্ট করে নেয় কারণ মানুষের মনে একটা অলরেডি ভালোলাগা তৈরি হয়ে আছে। আপনি কিন্তু নতুন , তাই এগুলো আপনার মাথায় রাখা জরুরি।
আপনি পাঠকের জায়গায় নিজেকে রেখে ভাবুন। ধরুন কোনো বই এর দোকানে গেছেন , বুকশেলফ থেকে একজন অচেনা লেখকের বই হাতে নিলেন। প্রথমে কি দেখবেন? ব্যাক কভার এর সামনের দিকে লেখক পরিচিতি দেখবেন তারপর সোজা চলে আসবেন সূচিপত্রে। এরপর ভূমিকাটা একটু পড়ে দেখবেন।
নতুন লেখকের বইটা হাতে নিয়েই যদি দেখেন লেখক পরিচিতি নেই, সূচিপত্রটা কেমন যেনো খাপছাড়া। ভূমিকাটাও তথৈবচ.....আপনি কি আর মূল লেখাটা পড়ে দেখবেন?
একশো জনের মধ্যে নব্বই জন আসল লেখার মধ্যে যাবেই না , অন্য আর একটা বই টেনে দেখতে শুরু করে দেবেন।
তাই নতুন লেখক হলে এগুলো নজর রাখুন। প্রকাশক কে বলে দিন যেনো পাতার কোয়ালিটি ভালো হয়, প্রিন্ট কোয়ালিটি ভালো থাকে। উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে প্রচ্ছদটা কোনো ভালো আর্টিস্ট কে দিয়ে করিয়ে নিন।
আজকাল ফেসবুকেই অনেককে কি সুন্দর প্রচ্ছদ করতে দেখি। আমি নিজেই সেদিন একজনকে বলে রাখলাম আমার লেখা কমপ্লিট হলে ওনার সাথে যোগাযোগ করবো প্রচ্ছদটা বানিয়ে দেওয়ার জন্য ।
AI দিয়ে প্রচ্ছদ বানানোটা এড়িয়ে চলুন।বড্ডো বেশি কৃত্রিম বলে মনে হয় । প্রচ্ছদ এর যত্ন নিন ... বই এর ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন নতুন পাঠক আপনার বইটা টেনে নেবে কিন্তু প্রচ্ছদ দেখেই! এই সহজ সত্য টা যতো তাড়াতাড়ি বুঝবেন আপনার ততই মঙ্গল।
অনেক নতুন লেখক লেখিকাকেই দেখি লেখক পরিচিতি, ভূমিকা , সূচিপত্র এই তিনটে জিনিসকে অবহেলা করতে। ভুল , এটাও খুব দামী ভুল। একটা ঘন্টাও লাগবে না এই তিনটিকে ভালো করে বানাতে , কিন্তু এই একটা ঘণ্টাই বাদে অনেকটা ফারাক গড়ে দেবে ।
তাই আবারও বলছি ....বই এর প্রচ্ছদ , লেখক পরিচিতি, ভূমিকা , সূচিপত্র, পাতার কোয়ালিটি আর প্রিন্ট কোয়ালিটি নিয়ে কোনো আপস করবেন না , অন্তত আপনার প্রথম বই এর ক্ষেত্রে।
২. এরপর আসে প্রুফ রিডিং , এটাও খুব খুব ভালোভাবে করান। প্রয়োজনে একজনের জায়গায় দুজনকে দিয়ে প্রুফ রিডিং করান। ফেসবুকে একটা দুটো বানান ভুল থাকলেও লোকে খুব বেশি কিছু মনে করে না, কারণ ফ্রিতে পড়ছে।
একজন পাঠক , যিনি টাকা দিয়ে আপনার বইটা কিনছেন , বানান ভুল থাকলে সেটা পাঠকের গায়ে লাগে। ছাপা বইয়ে বানান ভুল পোকা ধরা ফলের মতোই ...দিনের শেষে বদনাম। আর তাছাড়া , যেকোনো সেলেবেল প্রোডাক্ট যতোটা সম্ভব নিখুঁতভাবেই ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া উচিত। তাতে ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে ভালো বিজনেস রিলেশন তৈরি হয় ।
টাকা দিয়ে বই কিনে তাতে বানান ভুল পেলে পরের বই কেনার আগে সেই পাঠক দুবারের জায়গায় তিনবার ভাববে।
৩. বই পাবলিশ হওয়ার পর রিভিউ দরকার পাবলিসিটির জন্য। কিন্তু আসল রিভিউটা হওয়ার দরকার প্রিন্ট হওয়ার আগেই...এটাকে বলে প্রিরিভিউ । বড়ো বড়ো কিছু পাবলিশার এটা করে ...শুধু করে না , খুব গুরুত্ব দিয়ে করে। আমিও এইরকম কয়েকটা প্যানেলে থেকে দেখেছি , এটা লেখক বা লেখিকাকে অনেকটাই সাহায্য করে।
যাদের সাহিত্যজ্ঞান আছে বলে আপনার মনে হয় এরকম চার পাঁচজনকে আপনার স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বলুন। সবার ফিডব্যাক নিয়ে নিজে আর একবার বসুন। একটু ভাষার এদিক ওদিক কিন্তু একটা মাঝারি মানের লেখাকে বেশ ভালো লেখা করে দিতে পারে। অনেকেই এই ফাইন টিউনিংটা স্কিপ করে যান।
অবশ্যই প্রিরিভিউইয়ারদের সাথে কনফিডেন্সসিয়ালিটি এগ্রিমেন্ট করিয়ে নিন , যাতে প্রিন্ট হওয়ার আগে আপনার কনটেন্ট প্রাইভেট থাকে।
৪. নতুন লেখকের দায় পাঠকের কাছে পৌঁছানোর । পাবলিশার বলে এই দায় তাদের , কিন্তু দিনের শেষে আপনার বই , আপনার দায়। শুনতে খারাপ লাগলেও বই পাবলিশ হওয়ার পর এটা হাড়ে হাড়ে বুঝবেন ।
ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমকে হেলাফেলা করবেন না , নিজের ঢোল পেটাতে লজ্জা পাবেন না। নিজের টাইমলাইনে লিখুন আপনার ক্রিয়েশন নিয়ে। যাঁরা লেখালিখি করেন তাদের বই পাঠিয়ে রিভিউ করতে বলুন। আপনার কলমের জোর যতই থাকুক না কেনো, এই প্রথম দিকের স্ট্রাগলটা আপনাকে নিতেই হবে... আপনি ছাড়া আর কেউ নেবে না এই দায়।
বিল গেটসও উইন্ডোজ মেসিন বানানোর পর বাড়ি বাড়ি, অফিসে অফিসে ঘুরে বেরিয়েছিল প্রচার করতে । বিল গেটসকে নিজের ঢোল পেটাতে হয়ে থাকলে আপনাকেও হবে ।
অনেকে চমকদার প্রচার করেন , ওইগুলো করার প্রাথমিক কিছু বেনিফিট থাকলেও লং রানে ক্ষতি করে। বাংলাদেশের বইমেলাতে এরকম দুজনকে দেখলাম । একজন কেঁদে কেঁদে বই এর প্রচার করছেন তো অন্যজন নিজেদের বিবাহিত জীবনকে নিয়ে।
এরকম চমকদার কিছু না করে কপিবুক প্রচার করুন না নিজের বই এর...ক্ষতি কি। প্রচার দরকার।
৫. ফেসবুকে অনেক ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষ প্রোফাইল খুলে বসে থাকে লোকজনের ভুল ধরার জন্য। এদের কারো খপ্পরে আপনি পড়ে গেলে এদের কোনো রিপ্লাই করবেন না। ইগনোর করুন... দেখবেন একদিন দুদিন বাদে উৎসাহ হারিয়ে অন্য শিকার ধরতে বেরোবে। আপনাকে আর জ্বালাবে না ।
এদের শিক্ষা দিতে গিয়ে ফেসবুকে জ্বালাময়ী লেখা দেবেন না। দিতে খুব ইচ্ছা হবে , মনে হয় দি ভালো করে মুখে ঝামা ঘষে.... দেবেন না। আপনার ইমেজ খারাপ হবে।
ইমেজ ভালো রাখুন। একবার ইমেজ খারাপ হয়ে গেলে রিকভারি হতে অনেকটা টাইম লেগে যাবে।
কিছু ভদ্র মানুষ আছেন, যাঁরা আপনার উন্নতি কামনা থেকে আপনি ভুল ধরবেন, এদের সন্মান দিন। এনারা পুরানো দিনের মানুষ, চট করে পাওয়া যায় না। পেলে জুড়ে নিন এদের আপনার কলমের সাথে।
শুধু কলমের জোর থাকলেই হবে না।একটু মার্কেটিংটাও জানা দরকার।
একদম শেষে বলি...লেগে থাকুন। বিখ্যাত লেখক/লেখিকা কেউ একদিনে হয় না। আজ আপনার লেখার মান কম...কিন্তু লেগে থাকলে কাল আপনার লেখার মানের উন্নতি হবে। কলমের জোর বাড়লে পাঠকও বাড়বে , পরিচিতিও বাড়বে।
অনেককেই দেখি প্রথম বই সেল হচ্ছে না বলে ভেঙে পড়েন। বই পাবলিশ হওয়ার আগেই নিজের মনকে বোঝান দশ কপির বেশি কেউ কিনবে না। এক্সপেকটেশন কম রাখুন , পরিশ্রম করুন .....ফল পাবেন গ্যারান্টি।
লেখালিখি একটা শিল্পকলা । গানের টিচার হয় , আঁকার টিচার হয় ...কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে লেখালিখির ক্ষেত্রে এই চল নেই। কেনো নেই কোনো কারণ কিন্তু নেই!
যার লেখা ভালো লাগে সেরকম কাউকে অ্যাপ্রোচ করুন , তাকে গাইড করতে বলুন। অনেকেই সানন্দে আপনাকে গাইড করে দেবে....
কিন্তু প্রথম স্টেপটা আপনাকেই পেরোতে হবে ... স্টেপটার নাম "লজ্জা''।
লেখা- নীলাদ্রিশেখর ঘোষ
0 Comments